চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান ও ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এর সংক্ষিপ্ত নাম চবি, চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় অবস্থিত দেশের পঞ্চম সরকারি এবং একটি স্বায়ত্তশাসিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আয়তনের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর ক্যাম্পাসটি “গানের ক্যাম্পাস” নামে পরিচিত। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে বহু-অনুষদভিত্তিক গবেষণার একটি অন্যতম কেন্দ্র।এটি দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবেষ্টিত একটি পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত, যা দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এটি ভিন্নতা এনে দেয়। এর পরিচ্ছন্ন ও সবুজ মনোরম পরিবেশ শিক্ষার্থীদের এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেয়।
চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের পর থেকেই অনুভূত হয়। ১৯৫৯ সালে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি কমিটি চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করে। এরপর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে। ১৯৬৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ১৯৬৬ সালে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই প্রতিষ্ঠান গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছে।
২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় ২৭,৫৫০ শিক্ষার্থী এবং ৯০৭ জন শিক্ষক রয়েছেন। এর অধীনে ২১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত, যা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অনুষদ ও বিভাগসমূহ :
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৮টি অনুষদ এবং ৫৪টি বিভাগ রয়েছে। প্রধান অনুষদগুলো হলো:
- বিজ্ঞান অনুষদ
- কলা ও মানবিক অনুষদ
- ব্যবসা প্রশাসন অনুষদ
- সমাজবিজ্ঞান অনুষদ
- আইন অনুষদ
- প্রকৌশল অনুষদ
- জীববিজ্ঞান অনুষদ
- শিক্ষা অনুষদ
বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষার্থীদের আধুনিক গবেষণা ও শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। এখানে রয়েছে বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্র, যেমন-
- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা কেন্দ্র
- বন ও পরিবেশ গবেষণা কেন্দ্র
- সমুদ্রবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট
- প্রাণিবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র
বিশ্ববিদ্যালয়টির আরেকটি বিশেষ ভালো দিক হলো এর বিশাল গ্রন্থাগার, যা দেশের অন্যতম বড় গ্রন্থাগার। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। এখানে ছাত্রজীবন অত্যন্ত প্রাণবন্ত এবং এখানে রয়েছে বিভিন্ন ক্লাব, সংগঠন এবং ক্রীড়া কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠনগুলো বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং শিক্ষামূলক কার্যক্রম আয়োজন করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় আকর্ষণ শাটল ট্রেন। প্রতিদিন শত শত শিক্ষার্থী এই ট্রেনে চড়ে ক্যাম্পাসে যাতায়ত করেন, যা শুধুমাত্র পরিবহন নয় বরং একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশে পরিণত হয়েছে।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন এক নোবেল বিজয়ী এবং একাধিক একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তি। এটি দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদানের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি অনন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর জাতিগত বৈচিত্র্য এক সুরে মিলে গেছে। আয়তনের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় এই ক্যাম্পাস যেন একটি বিশাল উন্মুক্ত ক্লাসরুম।
চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত ব্যবস্থাও বেশ উন্নত। শাটল ট্রেন এবং সার্বক্ষণিক লোকাল বাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ সুবিধা। তবে শাটল ট্রেন শুধু একটি পরিবহন নয়, এতে মিশে আছে শিক্ষার্থীদের আবেগ-আনুভূতি, এটি চবির শিক্ষার্থীদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিদিন ট্রেনে একসঙ্গে যাওয়া-আসা করতে করতে বন্ধুত্বের যে বন্ধন গড়ে ওঠে, তা স্মরণীয় হয়ে থাকে সবার জীবনজুড়ে। শহর থেকে ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। এই সময়ে বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা, গান শোনা, বই পড়া কিংবা মুঠোফোনে সিনেমা দেখার মতো কাজগুলো বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। এমনকি এই সময়টা অনেকেই পড়াশোনার জন্যও কাজে লাগান।
শাটল ট্রেনে যাতায়াতের জন্য শিক্ষার্থীদের বছরে নামমাত্র একটি এককালীন ভাড়া দিতে হয়। আর যারা হলে থাকতে চান, তাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ৮টি ছাত্র হল, ৪টি ছাত্রী হল এবং ১টি ছাত্রাবাস। নির্ধারিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা হলে থাকার অনুমতি পেয়ে থাকেন।
বিশেষত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় র্যাগিংমুক্ত, যা দেশের অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। এখানে শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত সময়েই স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করতে পারে, ফলে দেরি হওয়ার কোনো অজুহাত নেই।
উচ্চশিক্ষার জন্য এমন একটি পরিবেশ যেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মানসম্মত শিক্ষা এবং বন্ধুত্বের গভীরতা সবকিছুই একত্রে পাওয়া যায়। তাই উচ্চশিক্ষার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে উপযুক্ত একটি পছন্দ হতে পারে।