অবশেষে বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯৭২ সালের ৪ মে থেকে তাঁকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আতাউর রহমান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, গত ডিসেম্বরে উপদেষ্টা পরিষদের এক সভায় অনুমোদিত প্রস্তাব অনুযায়ী কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এই ঘোষণা সবার অবগতির জন্য গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ৫ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এরপর এটি চূড়ান্ত স্বীকৃতি পায় এবং প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হয়।
উল্লেখ্য, কাজী নজরুল ইসলামের জাতীয় কবি হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার দাবি দীর্ঘদিন ধরেই দেশের মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ছিল। ১৯৭২ সালে তাঁর ঢাকায় আগমনের পর থেকেই এই দাবি আরও জোরালো হয়। এ বিষয়ে সরকারিভাবে প্রজ্ঞাপন জারির জন্য জনসাধারণের প্রত্যাশা ছিল। উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সেই প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে।
রাষ্ট্রীয়ভাবে এই স্বীকৃতি কাজী নজরুল ইসলামের অনন্য অবদান এবং তাঁর অমর সৃষ্টিকর্মের প্রতি জাতির সম্মান প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম
যার প্রতিটি কবিতা, গান ও গল্পে উঠে এসেছে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং শোষিত মানুষের আর্তনাদ, সেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি।
জন্ম ও শৈশব
১৮৯৯ সালের ২৪ মে, ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির চুরুলিয়া গ্রামে (বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া ব্লক) জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। বাবা কাজী ফকির আহম্মেদ ও মা জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান ছিলেন তিনি। শৈশবে দারিদ্র্যের ছাপ থাকা সত্ত্বেও নজরুলের প্রতিভা ছিল অমলিন। পরিবারের সবাই ভালোবেসে তাঁকে ডাকতেন “দুখু মিয়া”।
শিক্ষা জীবন
শৈশবেই নজরুলের শিক্ষাজীবন শুরু হলেও মাত্র ৯ বছর বয়সে পিতৃবিয়োগের পর তা বাধাগ্রস্ত হয়। পরিবারকে সাহায্য করতে বাধ্য হয়ে নানা কাজ করতে হলেও তিনি স্থানীয় মক্তবে কুরআন, ইসলামিক দর্শন এবং ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন। পরবর্তী সময়ে মক্তবে শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেছেন।
কর্মজীবনের শুরু
নজরুলের কর্মজীবন শুরু হয় মাত্র দশ বছর বয়সে। তিনি মক্তবের শিক্ষকতা, মসজিদের মুয়াজ্জিন, এমনকি কবরের সেবক হিসেবেও কাজ করেছেন। তবে তাঁর প্রতিভা বিকাশের প্রকৃত সূচনা ঘটে লেটো দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে। এই ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল তাঁকে গান, কবিতা ও অভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট করে। পরবর্তীতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং সেখানেও তাঁর সৃজনশীলতা বিকশিত হয়।
সমসাময়িক সময়ে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন এবং বিশ্বযুদ্ধ নজরুলের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। এসব ঘটনা তাঁর বিদ্রোহী চেতনাকে আরও প্রজ্বলিত করে। তিনি তাঁর কবিতায় শোষিত মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেন। নজরুল সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও কাজ করেছেন এবং তাঁর লেখার মাধ্যমে সমাজের অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন।
মানুষের কবি
নজরুল ছিলেন সর্বজনীন মানবতার কবি। তিনি মানুষের সমান অধিকার, প্রেম, প্রীতি, সাহসিকতা এবং স্বাধীনতার কথা বলেছেন। তাঁর অমর কবিতা “আমার কৈফিয়ৎ” মানবমুক্তির প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের প্রতিফলন। এসব কারণেই তিনি “মানুষের কবি” নামে পরিচিত।
বিদ্রোহের কবি
মানবিক গুণে সমৃদ্ধ কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর লেখনীর মাধ্যমে মানুষের ওপর হওয়া শোষণ, নির্যাতন এবং অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। তিনি অরাজনৈতিকভাবে বিদ্রোহের মন্ত্র ছড়িয়ে মানুষের হৃদয়ে জাগ্রত করেছেন প্রতিবাদের সুর। তাঁর অমর সৃষ্টি “অগ্নিবীণা” (১৯২২), “ভাঙার গান” (১৯২৪) এবং “বিষের বাঁশি” (১৩৩১) এ বিদ্রোহী চেতনার প্রতিফলন দেখা যায়।
সাহিত্য কীর্তি
রবীন্দ্রনাথের কীর্তিময় সাহিত্য ভাণ্ডারের মধ্য গগনে দাঁড়িয়ে নজরুল তাঁর স্বতন্ত্র বিদ্রোহী বার্তা নিয়ে বাংলা সাহিত্যকে নতুন মাত্রা দেন। তাঁর কবিতা ও গানে প্রেম, সাম্যবাদ, এবং মানবতার আহ্বান দুই বাংলার মানুষকে একত্রিত করেছে। নজরুলের অমর রচনা সংকলনগুলোর মধ্যে “দোলনচাঁপা” (১৯২৭), “চক্রবাক” (১৯২৯), “সিন্ধু হিল্লোল” (১৯২৭) এবং “অগ্নিবীণা” (১৯২২) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া গল্প সংকলন “ব্যথার দান” (১৯২২) ও “যুগবাণী” তাঁকে এনে দেয় বিশাল খ্যাতি।
চলচ্চিত্রে অবদান
নজরুলের প্রতিভা কেবল সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; তিনি চলচ্চিত্রেও সমান দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি “ধূপছায়া” চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন এবং “পাতালপুরী”, “গোরা”, “রজতজয়ন্তী”, “সাপুড়ে”, ও “নন্দিনী”-এর মতো চলচ্চিত্রে গীতিকার, সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এমনকি হিন্দি চলচ্চিত্রের জন্যও তিনি গান লিখেছিলেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
নজরুল তাঁর সাহিত্য ও সঙ্গীত প্রতিভার জন্য অসংখ্য সম্মাননা অর্জন করেন। ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে “জগত্তারিণী স্বর্ণপদক” প্রদান করে। ১৯৬০ সালে তিনি ভারতের “পদ্মভূষণ” সম্মাননায় ভূষিত হন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট উপাধি দেয়। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে নাগরিকত্ব প্রদান করে এবং “একুশে পদক” প্রদান করে। তাঁর নামে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে “জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়”, যা ২০০৫ সালে স্থাপিত হয়।
জীবনাবসান
জীবনের শেষ সময়ে বাকশক্তিহীন অবস্থায় কঠিন দিনযাপন করতে হয় নজরুলকে। তীব্র শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার পিজি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
কাজী নজরুল ইসলামের জীবন শুধু এক বিদ্রোহীর নয়, এটি মানবতার, সাম্যের এবং সৃষ্টিশীলতার এক অনন্য উদাহরণ। তাঁর কীর্তি চিরকাল বাংলার মাটিতে অম্লান হয়ে থাকবে।