বিটকয়েন হলো এক ধরনের ডিজিটাল মুদ্রা, যা কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ, সরকার বা ব্যাংকের তদারকির বাইরে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়। প্রতিটি লেনদেনের তথ্য রাখা হয় একটি পাবলিক লেজারে, যা নোড নামের হাজার হাজার সার্ভারে সংরক্ষিত। লেনদেনের তথ্য নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন নোডে শেয়ার করা হয়।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে ক্রিপ্টোকারেন্সির রাজধানী বানানো হবে এবং বিটকয়েনের একটি কৌশলগত মজুত গড়ে তোলা হবে। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে বিটকয়েনের রমরমা অবস্থা শুরু হয়। ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা হিসেবে বিটকয়েন একের পর এক দামের রেকর্ড গড়ে, ২০২৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর, প্রতিটি বিটকয়েনের মূল্য রেকর্ড ১,০৭,০০০ ডলারে পৌঁছায়, যা এর ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ফলে বিটকয়েনকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে এক অভূতপূর্ব উন্মাদনা তৈরি হয়েছে।
বিটকয়েনের উৎপত্তি
২০০৮ সালে সাতোশি নাকামোতো নামের এক রহস্যময় ব্যক্তিত্ব বিটকয়েন ধারণাটি প্রথম তুলে ধরেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন মারতি মালমি। সাতোশি নাকামোতো আদৌ একজন ব্যক্তি নাকি একটি দল, তা আজও রহস্যময়। তিনি প্রকাশ করেন একটি শ্বেতপত্র—‘বিটকয়েন: আ পিয়ার-টু-পিয়ার ইলেকট্রনিক ক্যাশ সিস্টেম’। এতে একটি বিকেন্দ্রীকৃত মুদ্রা সিস্টেমের নকশা তুলে ধরা হয়, যেখানে প্রতিষ্ঠান বা সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা থাকবে না।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে বিটকয়েন নেটওয়ার্ক চালু হয়। ওই সময় প্রথম বিটকয়েন ব্লক মাইন করা হয়, যা ব্লক জিরো নামে পরিচিত।
বিটকয়েন মাইনিং
বিটকয়েন মাইনিং বলতে বোঝায় নতুন বিটকয়েন তৈরির একটি জটিল প্রক্রিয়া। এতে অত্যন্ত শক্তিশালী ও দামি কম্পিউটার ব্যবহার করে কঠিন গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে হয়। মাইনারদের কাজ হলো এই সমস্যার উত্তর বের করা বা তার কাছাকাছি পৌঁছানো। মাইনাররা যে সমস্যার সমাধান করেন, সেটি হ্যাশ নামে পরিচিত। যত বেশি মাইনার এই নেটওয়ার্কে যুক্ত হন, ততই সমস্যার সমাধান জটিল হয়ে ওঠে। একেকটি বিটকয়েন মাইন করার প্রক্রিয়া অনেকটা খনিজ উত্তোলনের মতো, যেখানে নির্দিষ্টসংখ্যক বিটকয়েন পাওয়া যায়, যা আগেই নির্ধারিত থাকে।
বিটকয়েন মাইনিংয়ের জন্য শুরুতে সাধারণ কম্পিউটার ব্যবহার করা যেত। তবে বিটকয়েনের জনপ্রিয়তা ও মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাইনিং প্রক্রিয়া জটিল হয়ে উঠেছে। বর্তমানে শক্তিশালী হার্ডওয়্যার, যেমন অ্যাপ্লিকেশন স্পেসিফিক ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটস (ASIC), ব্যবহার করা হয়। এই যন্ত্র প্রতি সেকেন্ডে ৪০০ ট্রিলিয়ন হ্যাশ প্রক্রিয়া করতে সক্ষম। অন্যদিকে সাধারণ পিসি এর তুলনায় সেকেন্ডে মাত্র ১০ কোটি হ্যাশ সম্পাদন করতে পারে।
বর্তমানে নেটওয়ার্কে মাইনাররা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৭৪৫ কুইন্টিলিয়ন হ্যাশ নিয়ে কাজ করছে। এটি নতুন মাইনারদের জন্য প্রতিযোগিতাকে আরও কঠিন করে তুলেছে। যদি আপনার কাছে একটি নতুন কম্পিউটারও থাকে, তবুও মাইনিংয়ের সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
বিটকয়েন মাইনিং অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। উন্নত হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের পাশাপাশি বিদ্যুতের পেছনেও বিশাল খরচ হয়। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বব্যাপী মাইনাররা যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন, তা পোল্যান্ডের মতো ৩ কোটি ৬৮ লাখ মানুষের দেশের বার্ষিক বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণকেও ছাড়িয়ে যায়। এই কারণে অনেক মাইনার একত্রিত হয়ে মাইনিং কার্যক্রম পরিচালনা করেন, যা খরচ কমাতে সাহায্য করে।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিটকয়েন মাইনিং করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে মোট বিটকয়েনের ৩৭.৮ শতাংশ তৈরি হয়। এর পরেই রয়েছে চীন (২১.১ শতাংশ) এবং কাজাখস্তান (১৩.২ শতাংশ)।
বিটকয়েন মাইনিং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির একটি উদাহরণ। তবে এটি শুধু প্রযুক্তিগত দক্ষতার বিষয় নয়, বরং এর জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, শক্তিশালী হার্ডওয়্যার এবং প্রচুর বিদ্যুৎ সরবরাহ। মাইনিং লাভজনক হবে কিনা, তা নির্ভর করে বিটকয়েনের বাজারমূল্য এবং মাইনিংয়ের পেছনের খরচের ওপর।
বিটকয়েন কি কেনা যায়?
হ্যাঁ, বিটকয়েন কিনতে পাওয়া যায়। এটি একটি জনপ্রিয় ক্রিপ্টোকারেন্সি যা বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ প্ল্যাটফর্মে কেনাবেচার জন্য সহজলভ্য। যদিও বিটকয়েন মাইনিং করতে প্রচুর সময়, বিদ্যুৎ এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা প্রয়োজন, কিন্তু সরাসরি ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ থেকে বিটকয়েন কেনা তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ।
বিটকয়েন কেনার জন্য সাধারণত প্রচলিত মুদ্রা (ফিয়াট কারেন্সি), যেমন মার্কিন ডলার বা ইউরো ব্যবহার করা হয়। তবে পুরো বিটকয়েন কেনা সবার জন্য সম্ভব নাও হতে পারে, কারণ এর মূল্য অনেক বেশি। এর বিকল্প হিসেবে, বিটকয়েনের খণ্ডাংশ, যেমন সাতোশি (বিটকয়েনের সবচেয়ে ছোট একক) কেনা যায়।
বিটকয়েনে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর দাম দ্রুত ওঠানামা করে, যা অনেক বিনিয়োগকারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। বিশ্বের কিছু দেশে বিটকয়েনে বিনিয়োগ করা আইনত নিষিদ্ধ। তাই বিনিয়োগের আগে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন এবং নিয়মকানুন ভালোভাবে যাচাই করে নেওয়া জরুরি।
বিটকয়েনের পেছনের প্রযুক্তি হলো ব্লকচেইন, যা অত্যন্ত সুরক্ষিত এবং স্বতন্ত্র। তবে বিটকয়েন উৎপাদনের হার নিয়ন্ত্রণ করতে হাভিং নামে একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। প্রতি চার বছর পরপর এই হাভিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিটকয়েন মাইনিং আরও কঠিন হয়ে যায় এবং উৎপাদন ধীরে ধীরে কমতে থাকে। বিটকয়েনের সর্বোচ্চ সরবরাহ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ কোটি ১০ লাখ। ধারণা করা হচ্ছে, ২১৪০ সালের মধ্যে সব বিটকয়েন বাজারে চলে আসবে।
যেমনভাবে একটি টাকা ১০০ পয়সায় ভাগ করা যায়, ঠিক তেমনভাবেই বিটকয়েনকেও খণ্ডাংশে ভাগ করা যায়। একটি বিটকয়েনের ১০ কোটি ভাগের ১ ভাগ হলো সাতোশি। ফলে, বিটকয়েন ব্যবহার করে পণ্য বা সেবার মূল্য পরিশোধ করা সহজ।
বিটকয়েনের মালিকানা সংরক্ষণের জন্য প্রাইভেট কি ব্যবহার করা হয়, যা অত্যন্ত গোপনীয় এবং সুরক্ষিত থাকতে হয়। এটি ব্যবহারের জন্য একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি ওয়ালেট থাকা প্রয়োজন। এই ওয়ালেট বিটকয়েন সঞ্চয় এবং লেনদেনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিটকয়েন বা যেকোনো ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করার আগে সব ধরনের ঝুঁকি এবং সুযোগ ভালোভাবে বুঝে নেওয়া উচিত।