কম খরচে বিদেশ ভ্রমণের জন্য ১০ টি দেশ


ভ্রমণের পরিকল্পনা করলে সর্বপ্রথম আমাদেরকে খরচের হিসেব নিয়ে ভাবতে হয়। আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনা এমনভাবে করতে চাই যেন সর্বনিম্ন খরচে সর্বোচ্চ সুবিধা সহ সুন্দর একটি ভ্রমণ করতে পারি। খরচের কথা মাথায় রেখে আমরা আজকে জানবো কম খরচে বিদেশ ভ্রমণের জন্য ১০ টি দেশ সম্পর্কে।

কোথাও বেড়ানোর পরিকল্পনা করতে গেলে আমাদেরকে অনেক কিছুই মাথায় রাখতে হয়। পর্যটন সম্পর্কিত ওয়েবসাইট ঘেঁটে গন্তব্য নির্ধারণ, নিরাপদ দেশ বাছাই, ফ্লাইট বুকিং, বিদেশে লেনদেনের উপযোগী ট্রাভেল কার্ড নির্বাচন এবং ভ্রমণবিমা করাও এর মধ্যে পড়ে। অভিজ্ঞ পর্যটকেরা জানেন কীভাবে অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। উড়োজাহাজের ভাড়ায় ফ্রি মাইলেজ নেওয়া থেকে শুরু করে টাকা বিনিময়ের সেরা রেট—সবই তাঁদের নখদর্পণে।

তবে সবকিছুর ভিত্তি হলো—আপনি কতটা খরচ করতে প্রস্তুত? বাজেট সীমিত হলে অনেকেই সাশ্রয়ী বিকল্প খুঁজে নেন। বিশ্বজুড়ে এমন অনেক দেশ রয়েছে, যেখানে কম খরচে উপভোগ্য ভ্রমণ সম্ভব। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী ‘মানি উইক’ পর্যটকদের জন্য এমন সাশ্রয়ী দেশগুলোর একটি তালিকা তৈরি করেছে। চলুন, সে তালিকার সস্তা ১০টি দেশ এক নজরে দেখে নিই।

১. লাওস

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থলবেষ্টিত দেশ লাওস ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য একটি দারুণ সাশ্রয়ী গন্তব্য। যদিও এর কোনো সমুদ্রসীমা নেই, তবে এখানকার চার হাজারেরও বেশি দ্বীপ একে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। শতবর্ষ পুরোনো বৌদ্ধ স্তূপ, নিরিবিলি ফরাসি ক্যাফে আর ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পে ঠাসা রাতের বাজার লাওসকে করেছে সত্যিকারের ব্যতিক্রমী।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এখনও তেমন কোনো আধুনিক হস্তক্ষেপ পড়েনি। পর্যটকরা উপভোগ করতে পারেন স্থানীয় মুখরোচক খাবার, জঙ্গল পথে হাঁটা, মন্দির ভ্রমণ এবং ঝরনা দর্শনের মতো অভিজ্ঞতা। প্রতিদিন থাকার জন্য জনপ্রতি গড়পড়তা খরচ প্রায় ১২ পাউন্ড এবং খাবারের জন্য ৮ পাউন্ড, অর্থাৎ দৈনিক আনুমানিক সাড়ে তিন হাজার টাকায় থাকা-খাওয়া সম্ভব।

২. ভিয়েতনাম

ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে ভরপুর একটি অপূর্ব দেশ ভিয়েতনাম, যেখানে প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসের ছোঁয়া। এখানে রয়েছে ইউনেসকো স্বীকৃত আটটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং রয়েছে বান মির মতো অসাধারণ স্বাদের স্থানীয় খাবার।
হো চি মিন শহরের প্রাণবন্ত পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবে, আর হা লং বে কিংবা বিশ্বের বৃহত্তম গুহা ‘ফং না-কে বাং’ জাতীয় উদ্যানে ভ্রমণ আপনার অভিজ্ঞতাকে করবে আরও রঙিন। ব্যয়ের দিক থেকেও এটি বেশ সাশ্রয়ী—প্রতিদিন থাকার জন্য জনপ্রতি গড়পড়তা খরচ ২২ পাউন্ড এবং খাবারের জন্য ১৬ পাউন্ড, অর্থাৎ দৈনিক আনুমানিক ছয় হাজার টাকায় থাকাও ও খাওয়াও সম্ভব।

৩. ইন্দোনেশিয়া

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপদেশ ইন্দোনেশিয়া গঠিত প্রায় ১৭ হাজারের বেশি দ্বীপ নিয়ে। যা ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য এক স্বপ্নের গন্তব্য। দেশটির গহিন জঙ্গলে রয়েছে ওরাংওটানের আবাস। পাশাপাশি দর্শনীয় আগ্নেয়গিরি, গোলাপি বালুর সমুদ্রসৈকত এবং আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে গঠিত নান্দনিক হ্রদ।

ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় দ্বীপগুলোর একটি হলো বালি। যার নাম নিয়মিতভাবে বিশ্বের সেরা ভ্রমণস্থানগুলোর তালিকায় উঠে আসে।
পর্যটকেরা এখানে স্বল্প খরচে উপভোগ করতে পারেন চমৎকার আতিথেয়তা, সুস্বাদু খাবার আর অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। প্রতিদিন থাকার জন্য জনপ্রতি গড়পড়তা খরচ ২৪ পাউন্ড এবং খাবারের জন্য ২০ পাউন্ড। অর্থাৎ আনুমানিক সাত হাজার টাকার মধ্যেই দৈনিক থাকা-খাওয়ার পুরো খরচ মিটে যায়।

৪. থাইল্যান্ড

থাইল্যান্ড দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এমন একটি দেশ, যা তার জঙ্গলঘেরা প্রাচীন মন্দির, উষ্ণমণ্ডলীয় সৈকত, মজাদার খাবার এবং হাতির অভয়ারণ্যের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।

ব্যাংকক কিংবা ফুকেটের মতো শহরগুলোতে রয়েছে নানান রকম শপিং সুবিধা, রঙিন রাতের বাজার ও উচ্ছ্বাসে ভরা শহুরে জীবন। অন্যদিকে, কো ফি ফি বা কো সামুই দ্বীপে নিরিবিলি পরিবেশে ছুটি কাটানোর অপার সুযোগও রয়েছে।

থাইল্যান্ডে ভ্রমণ মানেই প্রত্যেকের পছন্দের জন্য কিছু না কিছু থাকবেই। প্রতিদিন থাকার জন্য গড় খরচ জনপ্রতি ২৯ পাউন্ড এবং খাবারের জন্য ২২ পাউন্ড—অর্থাৎ দিনে আনুমানিক সাড়ে আট হাজার টাকায় থাকা ও খাওয়া সম্ভব।

৫. দক্ষিণ আফ্রিকা

সাফারি ও বন্যপ্রাণীপ্রেমীদের জন্য স্বর্গসম এই দক্ষিণ আফ্রিকা এবার স্থান করে নিয়েছে নতুনভাবে সাজানো সাশ্রয়ী ভ্রমণ তালিকায়। এই দেশেই রয়েছে ‘বিগ ফাইভ’ নামে খ্যাত বিশ্বের পাঁচটি সবচেয়ে বিখ্যাত ও দুর্লভ বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল—হাতি, মহিষ, গন্ডার, সিংহ ও চিতা। দেশটির জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্যগুলোতে সহজেই এই প্রাণীদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ মেলে।

আরও পড়ুন: বিশ্বের শীর্ষ ১০ শক্তিশালী পাসপোর্ট এর তালিকা প্রকাশ

তবে কেবল বন্যপ্রাণী দেখেই নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় আরও নানা উপায়ে। পর্যটকেরা নামাকোয়া অঞ্চলের বুনো ফুলের সমারোহে হাঁটতে পারেন, টেবল মাউন্টেনের চূড়ায় উঠতে পারেন কিংবা তিমি দেখার দারুণ অভিজ্ঞতা নিতে পারেন। কেউ চাইলে সমুদ্রসৈকতে বসে নিরালায় সময় কাটাতেও পারেন। রোমাঞ্চপ্রেমীরা আবার সার্ফিং বা হাঙরের সঙ্গে ডাইভিংয়ের মতো অ্যাডভেঞ্চারেও অংশ নিতে পারেন।

প্রতিদিনের গড় খরচ হিসেব করলে, একজন পর্যটকের থাকার জন্য প্রয়োজন হবে প্রায় ৩৭ পাউন্ড এবং খাওয়ার জন্য ২৭ পাউন্ড। অর্থাৎ দৈনিক আনুমানিক ১১ হাজার টাকার কম খরচেই দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা ও খাওয়া সম্ভব।

৬. তুরস্ক

রসনাবিলাস ও ঐতিহ্যের অপূর্ব সংমিশ্রণে গঠিত তুরস্ক পর্যটকদের জন্য এক দুর্দান্ত গন্তব্য। কাবাব, মেজে প্ল্যাটার, খাস্তা বাকালাভা কিংবা মিষ্টিজাতীয় খাবারের ভান্ডার এই দেশ, যা খাবারপ্রেমীদের মনে আলাদা স্থান করে নেয়। বিশ্ব পর্যটনে অন্যতম জনপ্রিয় গন্তব্য এই দেশটি নানা ধরনের দর্শনীয় স্থানেও সমৃদ্ধ।

তুরস্কের রাজপ্রাসাদ, ভূগর্ভস্থ নগরী এবং এজিয়ান সাগরের তীরে ছবির মতো সাজানো সৈকত পর্যটকদের মোহিত করে। ঐতিহাসিক শহর ইস্তাম্বুলে রয়েছে বিশ্বখ্যাত আয়া সোফিয়া ও তোপকাপি প্রাসাদ, যেখানে ইতিহাস ও সংস্কৃতি মিলেমিশে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা তৈরি করে।

যাঁরা একটু ভিন্নধর্মী রোমাঞ্চ চান, তাঁদের জন্য রয়েছে কাপাদোকিয়া অঞ্চল। এখানে রঙিন হট এয়ার বেলুনে ভেসে বেড়ানো কিংবা প্রাচীন গুহাবাসীদের বসবাসের নিদর্শন ঘুরে দেখার সুযোগ রয়েছে।

প্রতিদিনের গড় খরচ অনুযায়ী, একজন পর্যটকের থাকার জন্য প্রয়োজন হবে ৪১ পাউন্ড এবং খাওয়ার জন্য ২৪ পাউন্ড। অর্থাৎ দৈনিক আনুমানিক সাড়ে ১০ হাজার টাকায় তুরস্ক ভ্রমণের খরচ সহজেই সামলানো যাবে।

৭. মেক্সিকো

অসাধারণ খাবার এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনের জন্য বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছে মেক্সিকো। এখানকার সৈকতগুলো প্রায়ই বিশ্বের সেরা সৈকতের তালিকায় জায়গা করে নেয়। দেশটির বুকে ছড়িয়ে আছে প্রাচীন আজটেক ও মায়া সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন, যেগুলো সাশ্রয়ী খরচেই ঘুরে দেখা সম্ভব।

কানকুনে অবস্থিত মুন প্যালেস রিসোর্ট এবং ড্রিমস রিভিয়েরা রিসোর্টের মতো রিসোর্টগুলো বিশ্বের সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর অবকাশ যাপনের স্থানগুলোর অন্যতম, যেখানে আপনি রাজার মতো অভিজাত আতিথেয়তা পাবেন। তবে মেক্সিকো ঘুরতে গিয়ে স্থানীয়দের মতো ‘টাকেরিয়াস’ নামে পরিচিত রাস্তাঘাটের খাবারের দোকানে না গেলেই নয়—সেখানে মেলে এমন সব স্বাদে ভরা খাবার, যা জিভে পানি এনে দেয়।

প্রতিদিন থাকার জন্য একজন পর্যটকের গড় খরচ প্রায় ৪৬ পাউন্ড এবং খাওয়ার জন্য প্রায় ১০ পাউন্ড, অর্থাৎ দৈনিক আনুমানিক সাড়ে ৯ হাজার টাকায় মেক্সিকোতে থাকা-খাওয়া সম্ভব।

৮. কোস্টারিকা

বিদেশে অবসর জীবনযাপনের জন্য ২০২৪ সালে সেরা দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল কোস্টারিকা। আন্তর্জাতিক জীবনযাপন সূচক (ইন্টারন্যাশনাল লিভিং ইনডেক্স)-এ আবাসন, জলবায়ু এবং খরচ বিবেচনায় দেশটি ছিল শীর্ষে।

মাঝারি আয়তনের মধ্য আমেরিকার এই দেশটি বৈচিত্র্যে ভরপুর। এখানে একসঙ্গে রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগর ও ক্যারিবীয় সাগরের উপকূল, ঘন সবুজ জঙ্গল এবং আগ্নেয়গিরি। পর্যটকেরা কোস্টারিকায় তিমি দেখার অভিজ্ঞতা নিতে পারেন, দেখতে পারেন কচ্ছপের ছানা ফোটার মুহূর্ত অথবা কাছ থেকে নির্ভার স্লথদের।

থাকার জন্য দিনে গড়পড়তা খরচ হয় ২৪ পাউন্ড এবং খাওয়ার জন্য ৯ পাউন্ড। অর্থাৎ দৈনিক আনুমানিক সাড়ে পাঁচ হাজার টাকায় কোস্টারিকায় থাকা-খাওয়া সম্ভব।

৯. ডমিনিকান রিপাবলিক

ডমিনিকান রিপাবলিকের আবহাওয়া সারা বছর জুড়েই মনোরম থাকে, ফলে মূল পর্যটন মৌসুম এড়িয়ে কম খরচে এই দ্বীপ ভ্রমণের সুযোগ নেওয়া যায়। এই দ্বীপে প্রতিটি ভ্রমণকারীর জন্য রয়েছে আলাদা অভিজ্ঞতা—কেউ চাইলে সমুদ্রসৈকতে অলস সময় কাটাতে পারেন, আবার কেউ বেছে নিতে পারেন ঘন বনে রোমাঞ্চকর অভিযানের পথ।

এছাড়াও পানিতে খেলাধুলার জন্য অসংখ্য সুযোগ রয়েছে, যেমন: স্কুবা ডাইভিং, পালতোলা নৌকায় ভ্রমণ, প্যাডেলবোর্ডিং অথবা ফ্লাইবোর্ডিংয়ের মতো দারুণ সব অ্যাডভেঞ্চার।

এই দেশে প্রতিদিন একজন পর্যটকের গড় আবাসন খরচ ৬৬ পাউন্ড এবং খাবারের জন্য খরচ হয় ৪৫ পাউন্ড। অর্থাৎ প্রতিদিন আনুমানিক সাড়ে ১৮ হাজার টাকায় থাকা ও খাওয়া সম্ভব।

১০. পর্তুগাল

পর্তুগাল বছরে প্রায় ৩০০ দিনের বেশি সময় রৌদ্রজ্জ্বল থাকে, যা একে করে তুলেছে ইউরোপের অন্যতম আকর্ষণীয় ও সাশ্রয়ী ভ্রমণ গন্তব্য। এখানে রয়েছে নয়নাভিরাম সমুদ্রসৈকত এবং প্রাণবন্ত শহর, যা নতুন জায়গা ঘুরে দেখার শখ পূরণে যথার্থ।

ভ্রমণপিপাসুরা পর্তুগালের উপকূলবর্তী আজোরিস দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে পর্বতারোহণের পাশাপাশি প্রকৃতির মনোরম দৃশ্যও উপভোগ করতে পারেন। প্রতিদিন জনপ্রতি গড় আবাসন খরচ ৮২ পাউন্ড এবং খাবারের জন্য খরচ ৪৩ পাউন্ড, অর্থাৎ দৈনিক আনুমানিক ২০ হাজার টাকার একটু বেশি খরচেই এই অভিজ্ঞতা পাওয়া যাবে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *