বিশ্বের শীর্ষ ১০ শক্তিশালী পাসপোর্ট এর তালিকা প্রকাশ


পাসপোর্ট একটি দেশের নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র। তবে এর শক্তি নির্ধারণ করে ওই দেশের বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা ও কূটনৈতিক সম্পর্ক। “পাসপোর্ট শক্তি” বা শক্তিশালী পাসপোর্ট বলতে বোঝানো হয়, কোনো দেশের নাগরিক তাদের পাসপোর্ট ব্যবহার করে কতটি দেশে ভিসা ছাড়া অথবা অন-অ্যারাইভাল ভিসার সুবিধায় প্রবেশ করতে পারেন।

একটি শক্তিশালী পাসপোর্ট মানে শুধুমাত্র ভ্রমণের সুবিধাই নয়। এটি একটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক শক্তি, পররাষ্ট্রনীতি ও বৈশ্বিক সম্মানের প্রতিফলন। যে দেশের পাসপোর্ট শক্তিশালী, সেই দেশের নাগরিকরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। তাদের জন্য ব্যবসা, শিক্ষা, চাকরি কিংবা চিকিৎসা নিতে অন্য দেশে যাওয়া সহজতর হয়।

যেমন ধরুন, জাপান বা সিঙ্গাপুরের পাসপোর্টধারীরা পৃথিবীর প্রায় ১৯০টিরও বেশি দেশে কোনো প্রকার পূর্বানুমোদিত ভিসা ছাড়াই ঢুকতে পারেন। এটি তাদের জন্য এক বিশাল সুযোগ। বিশ্বকে এক দৃষ্টিতে দেখার, সীমানা ছাড়িয়ে নিজেকে গড়ে তোলার।

অন্যদিকে, একটি দুর্বল পাসপোর্ট অনেক ভিসা বাধ্যবাধকতা নিয়ে আসে, যার কারণে অন্য দেশে যেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। যেমন ব্যাংক স্টেটমেন্ট, ইনভাইটেশন লেটার, রিটার্ন টিকিট, ইত্যাদি।

এই কারণে পাসপোর্টের শক্তিকে অনেকটাই দেশের ‘গ্লোবাল পাওয়ার’ বা ‘সফট পাওয়ার’-এর প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ করতে যারা আগ্রহী, তাদের জন্য একটি শক্তিশালী পাসপোর্ট স্বপ্নপূরণের চাবিকাঠি।

পাসপোর্ট র‍্যাংকিং যেভাবে নির্ধারণ করা হয়

বিশ্বের পাসপোর্ট শক্তির র‍্যাংকিং নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন বৈশ্বিক সংস্থা প্রতিবছর তালিকা প্রকাশ করে। এর মধ্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও জনপ্রিয় দুটি সূচক হলো:

হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স (Henley Passport Index)

হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স বিশ্বের ২০০টি দেশের পাসপোর্ট র‍্যাংকিং করে থাকে। এটি ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (IATA) এর ডেটা ব্যবহার করে এবং প্রতিনিয়ত আপডেট করে। র‍্যাংকিং করার সময় তারা দেখেন, কোন দেশের নাগরিকরা কতটি দেশে ভিসা ছাড়াই অথবা অন-অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে প্রবেশ করতে পারেন।

র‍্যাংকিংয়ের নিয়ম

  • প্রতি দেশ যেখানে ভিসা ছাড়া প্রবেশ সম্ভব, তার জন্য ১ পয়েন্ট।
  • যদি দেশটিতে অন-অ্যারাইভাল সুবিধা থাকে, তাও ১ পয়েন্ট।
  • তবে যেসব দেশে ভিসা দরকার, সেগুলোর জন্য কোনো পয়েন্ট দেওয়া হয় না।
  • এই স্কোরের ভিত্তিতে দেশগুলোর পাসপোর্ট শক্তি নির্ধারিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি জাপানের নাগরিকরা ১৯৪টি দেশে ভিসা ছাড়াই যেতে পারেন, তবে তাদের স্কোর হবে ১৯৪, যা তাকে শীর্ষে রাখবে।

আর্টন ক্যাপিটাল ইনডেক্স (Arton Capital’s Passport Index)

আর্টন ক্যাপিটাল একটি গ্লোবাল ফিনান্স কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান যারা পাসপোর্ট র‍্যাংকিং তৈরি করে থাকে তাদের নিজস্ব মেথোডলজি অনুসারে। এরা কিছুটা ভিন্নভাবে কাজ করে। তারা প্রতিটি পাসপোর্টের “ভিসা ফ্রি স্কোর”, “ওয়ার্ল্ড রিচ”, এবং “এনহ্যান্সমেন্ট ভ্যালু” হিসেব করে র‍্যাংক দেয়।

তাদের সূচকে শুধু ভিসা ফ্রি বা অন-অ্যারাইভাল নয়, পাশাপাশি ই-পাসপোর্ট, বায়োমেট্রিক সিকিউরিটি ও অন্যান্য ডিজিটাল সুবিধাও বিবেচনা করা হয়।

আর্টন ক্যাপিটাল প্রতি মুহূর্তে তাদের সূচক আপডেট করে, যার ফলে তাদের র‍্যাংকিং অনেক সময় হেনলি ইনডেক্স থেকে ভিন্ন হতে পারে।

হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স অনুযায়ী শীর্ষ ১০ শক্তিশালী পাসপোর্ট

২০২৫ সালের হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী পাসপোর্টধারী দেশগুলোর তালিকা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে ভিসামুক্ত ও অন-অ্যারাইভাল সুবিধার বিচারে এই তালিকা তৈরি করে হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স।

শীর্ষে রয়েছে সিঙ্গাপুর

প্রথম স্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর। তালিকায় দেখা যাচ্ছে, ভ্রমণ স্বাধীনতার দিক থেকে সিঙ্গাপুর এককভাবে শীর্ষস্থান দখল করেছে। সিঙ্গাপুরের নাগরিকরা এখন মোট ১৯৩টি দেশে ভিসা ছাড়াই বা অন-অ্যারাইভাল ভিসা গ্রহণ করে প্রবেশ করতে পারেন। এটি বৈশ্বিক যোগাযোগ, কৌশলগত কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং উন্নত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ফল।

আরও পড়ুন: ইউরোপের যে দেশগুলোতে স্টুডেন্ট ভিসা পাওয়ার সহজ

সিঙ্গাপুরের পাসপোর্টের এই শক্তির পেছনে মূল কারণ হচ্ছে এর দক্ষ কূটনৈতিক নীতি, আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য প্রশাসন এবং অত্যন্ত সুশৃঙ্খল পররাষ্ট্রনীতি। দেশটি তার স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে বাণিজ্য, শিক্ষা ও নিরাপত্তা ইস্যুতে চুক্তি করে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে।

সিঙ্গাপুরের পাসপোর্টধারীরা সহজেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক ও পর্যটন গন্তব্যগুলোতে যেতে পারেন।

দ্বিতীয় অবস্থানে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া

দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে প্রযুক্তি ও অর্থনীতির দিক থেকে সমৃদ্ধ দুই দেশ—জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। এই দুই দেশের নাগরিকদের জন্য ১৯০টি দেশ উন্মুক্ত, যেখানে তারা সহজেই ভিসা ছাড়াই প্রবেশ করতে পারেন।

তৃতীয় স্থানে ইউরোপের ৮ দেশ

তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে ইউরোপের আটটি দেশ—ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, স্পেন ও সুইজারল্যান্ড। এসব দেশের পাসপোর্টধারীরা ১৮৯টি দেশে যেতে পারেন ভিসামুক্ত সুবিধায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভ্রমণ চুক্তি ও শেনজেন নীতিমালার প্রভাব এখানে সুস্পষ্ট।

চতুর্থ থেকে দশম অবস্থান

চতুর্থ স্থানে রয়েছে অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পর্তুগাল ও সুইডেন—যাদের পাসপোর্টধারীরা ১৮৮টি দেশে ভিসা ছাড়াই প্রবেশের অধিকার পান।

পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে তিনটি দেশ—গ্রিস, নিউজিল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ড, যাদের নাগরিকরা ১৮৭টি দেশে প্রবেশাধিকার পান।

ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য, যেখানে ব্রিটিশ নাগরিকরা ১৮৬টি দেশে অনায়াসে ভ্রমণ করতে পারেন।

সপ্তম স্থানে যৌথভাবে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র (চেকিয়া), হাঙ্গেরি, মাল্টা ও পোল্যান্ড, যাদের পাসপোর্টধারীদের জন্য ১৮৫টি দেশ উন্মুক্ত।

অষ্টম অবস্থানে রয়েছে কানাডা, এস্তোনিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এই তিন দেশের নাগরিকরা ১৮৪টি দেশে ভিসা ছাড়াই অথবা আগমনের পর ভিসা নিয়ে প্রবেশ করতে পারেন।

নবম স্থানে রয়েছে ক্রোয়েশিয়া, লাটভিয়া, স্লোভাকিয়া ও স্লোভেনিয়া—যাদের নাগরিকদের জন্য ১৮৩টি দেশ ভিসামুক্ত বা অন-অ্যারাইভাল সুবিধা দেয়।

দশম স্থানে অবস্থান করছে আইসল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। এই দেশগুলোর নাগরিকরা ১৮২টি দেশে সহজে প্রবেশাধিকার পান।

বিশ্বব্যাপী এমন তালিকা মূলত নির্ভর করে একটি দেশের কূটনৈতিক দক্ষতা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যে দেশের বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা যত বেশি, সেই দেশের পাসপোর্ট ততই শক্তিশালী।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *