বিশ্বের সেরা ১০ হাসপাতাল (World’s Best 10 Hospital) সম্পর্কে জানার আগ্রহ সবার থাকে। নিজের কিংবা প্রিয়জনের চিকিৎসার উপযুক্ত হাসপাতাল খুঁজে পাওয়াটা অনেক সময় বেশ ঝামেলার হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেই এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব না দিয়ে ফেলে রাখেন। আবার কেউ কেউ সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে মানসিক চাপে ভেঙে পড়েন। যদি সহজেই জানা যেত কোথায় বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা মিলবে, তাহলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক সহজ হতো।
গ্লোবাল ডেটা প্ল্যাটফর্ম স্ট্যাটিস্টার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট হাসপাতালের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ২ লাখ ১৫ হাজার ৯৭৭-এ। এত বিপুলসংখ্যক হাসপাতালের মধ্যে মানসম্পন্ন সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানটি বাছাই করা সত্যিই চ্যালেঞ্জিং, কারণ অধিকাংশ হাসপাতালই যথাযথ তথ্য প্রদানে ব্যর্থ হয়।
নিউজউইক ও স্ট্যাটিস্টার র্যাঙ্কিং
এই সমস্যার সমাধানে এবং রোগীদের সহায়তা করার লক্ষ্যেই নিউজউইক ও স্ট্যাটিস্টা মিলে ২০২৫ সালে বিশ্বের সেরা হাসপাতালগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। এতে ২৫০টি হাসপাতালের নাম রয়েছে। এই তালিকায় শুধু শীর্ষস্থানীয় হাসপাতাল নয়, বরং দেশভিত্তিক সেরা হাসপাতালগুলোর র্যাঙ্কিংও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে—যাতে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী তথ্য পাওয়া সহজ হয়।
চলতি বছরের র্যাঙ্কিংয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ৩০টি দেশের সেরা হাসপাতাল। দেশগুলো হলো: অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, কানাডা, চিলি, কলম্বিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইসরায়েল, ইতালি, জাপান, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশ নির্বাচন করা হয়েছে নানা মানদণ্ডে—যেমন জীবনযাত্রার মান, গড় আয়ু, জনসংখ্যার আকার, হাসপাতালের সংখ্যা এবং তথ্য পাওয়ার সহজলভ্যতা।
২০২৫ সালের র্যাঙ্কিংয়ে ২ হাজার ৪০০–এরও বেশি হাসপাতাল স্থান পেয়েছে। তবে বিশ্বজুড়ে সেরা ২৫০টি হাসপাতালকে আলাদাভাবে তালিকায় তুলে ধরা হয়েছে। এই তালিকা থেকে বাছাই করা সেরা ১০টি হাসপাতাল নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদন।
১. মায়ো ক্লিনিক, যুক্তরাষ্ট্র
আমরা যখন ‘বিশ্বের সেরা হাসপাতাল’ কথাটি বলি, তখন মায়ো ক্লিনিক স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে আসে। মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের রচেস্টারে অবস্থিত এই হাসপাতালটি ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চিকিৎসা, গবেষণা ও রোগীর সেবায় অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে। এটি শুধু একটি হাসপাতাল নয়, বরং রোগী-কেন্দ্রিক একটি বৈশ্বিক উদাহরণ।
বিশেষত্ব
- রোগী প্রথম নীতিতে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান
- ৭০টির বেশি মেডিকেল ও সার্জিক্যাল স্পেশালটি
- বছরে গড়ে ১ মিলিয়নেরও বেশি রোগী সেবা গ্রহণ করে
মায়ো ক্লিনিক শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র থেকেই নয়, সারা বিশ্বের রোগীদের আগমনস্থল। তাদের রোগনির্ণয় পদ্ধতি এতটাই নির্ভরযোগ্য যে অনেক সময় অন্য হাসপাতাল থেকে ভুল ডায়াগনোসিস ঠিক করে দেয় এই প্রতিষ্ঠান।
এখানে চিকিৎসা কেবল রোগ নিরাময় নয়, বরং পুরো রোগী এবং তার পরিবারের সুস্থতার দিকটি বিবেচনায় রেখে পরিচালিত হয়। একটি দলভিত্তিক সেবা ব্যবস্থা থাকায় চিকিৎসকরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেন।
২. ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক, যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও রাজ্যের ক্লিভল্যান্ড শহরে অবস্থিত ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক দীর্ঘদিন ধরে হৃদ্রোগ চিকিৎসায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। তবে শুধু হৃদরোগই নয়, এটি আজ বহুমুখী চিকিৎসা সেবায় অন্যতম একটি নাম।
বিশেষত্ব
- সারা বিশ্বের রোগীদের জন্য বিশেষায়িত কার্ডিয়াক কেয়ার
- ৬৮টি অপারেটিং রুম ও ১৪০০ শয্যার সুবিধা
- প্রতি বছর প্রায় ৮.৮ মিলিয়ন রোগী চিকিৎসা গ্রহণ করে
সেবার বিস্তৃতি কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ নয়। ক্লিনিকটির ব্রাঞ্চ রয়েছে কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে।
ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক প্রতিনিয়ত চিকিৎসাবিজ্ঞানে গবেষণা করে যাচ্ছে। তাদের নিজস্ব গবেষণা কেন্দ্র ও একাডেমিক ইউনিট রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতিকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে।
৩. টরন্টো জেনারেল – ইউনিভার্সিটি হেলথ নেটওয়ার্ক, কানাডা
কানাডার স্বাস্থ্যব্যবস্থা অনেকেই উন্নত বলে জানেন। তবে টরন্টো জেনারেল হসপিটালকে বলা যায় সেই ব্যবস্থার গর্ব। ইউনিভার্সিটি হেলথ নেটওয়ার্কের অংশ এই হাসপাতালটিকে শুধুমাত্র কানাডার নয়, বিশ্বের অন্যতম সেরা বলা হয়।
বিশেষত্ব
- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অঙ্গপ্রতিস্থাপন ইউনিট এখানেই
- হৃদ্রোগ, ক্যানসার ও নিউরো-চিকিৎসায় অগ্রগামী
- রোগী-কেন্দ্রিক উচ্চমানের কেয়ার সিস্টেম
এই হাসপাতালের গবেষণা বিভাগ একাধিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। সারা বিশ্বের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মডেল অনুসরণ করছে।
হাসপাতালটি ডিজিটাল প্রযুক্তি ও AI ব্যবহারের মাধ্যমে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা পরিকল্পনা ও ফলো-আপ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে আধুনিক করে তুলেছে।
৪. জনস হপকিনস হাসপাতাল, যুক্তরাষ্ট্র
আমরা যারা মেডিক্যাল শিক্ষার কথা ভাবি, জনস হপকিনস নামটি সবার আগে আসে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেই নয়, হাসপাতাল হিসেবেও এটি সমান মর্যাদাপূর্ণ।
বিশেষত্ব
- যুক্ত আছে জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের সঙ্গে
- শিশুদের জন্য জনস হপকিনস চিলড্রেনস সেন্টার
- ক্যানসার রোগীদের জন্য কিমেল ক্যানসার সেন্টার
এই হাসপাতালটি শুধু চিকিৎসা নয়, গবেষণা ও শিক্ষায়ও নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। বিশ্বের বহু চিকিৎসক ও গবেষক এখান থেকে তৈরি হয়েছেন।
এখানে শুধু রোগ নিরাময় নয়, রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। রয়েছে সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট ইউনিট ও কাউন্সেলিং ব্যবস্থা।
৫. ক্যারোলিনস্কা ইউনিভার্সিটি হসপিটাল, সুইডেন
স্টকহোমে অবস্থিত এই হাসপাতালটি ইউরোপের অন্যতম আধুনিক ও উদ্ভাবনী একটি প্রতিষ্ঠান। চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণার মিলনস্থল এই ক্যারোলিনস্কা।
বিশেষত্ব
- নোবেল মেডিসিন পুরস্কার এখানেই ঘোষণা করা হয়
- প্রতিটি চিকিৎসা পদ্ধতিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার
- চিকিৎসা শিক্ষার্থীদের জন্য আদর্শ পরিবেশ
ক্যারোলিনস্কার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তাদের একাডেমিক ও ক্লিনিক্যাল সংযুক্তি। এখানে যেকোনো চিকিৎসার আগে চূড়ান্ত গবেষণা হয়। রোগীর নিরাপত্তা সবার আগে বিবেচনায় নেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: বিশ্বের সেরা ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় | Top 10 Universities in the World
৬. ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল, যুক্তরাষ্ট্র
বস্টনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল (Mass General) শুধু একটি চিকিৎসাকেন্দ্রই নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রাচীন ও সম্মানিত মেডিকেল প্রতিষ্ঠান। ১৮১১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতাল এখনও চিকিৎসা ও গবেষণার শীর্ষ স্থানে অবস্থান করছে।
বিশেষত্ব
- ইউএস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্টে (২০২৪-২৫) দেশটির সেরা হাসপাতাল হিসেবে স্বীকৃত
- ২৫টি ভিন্ন ভিন্ন স্পেশালিটিতে রোগীসেবা
- প্রতি বছর প্রায় ১.৫ মিলিয়নেরও বেশি রোগী এখানে চিকিৎসা নেন
Mass General এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে মেডিকেল, সার্জিক্যাল ও নিউরোসায়েন্স বিভাগে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায়। এটি হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের প্রধান শিক্ষণ হাসপাতাল হওয়ায় এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে।
৭. চ্যারিটি-ইউনিভার্সিটি মেডিসিন বার্লিন, জার্মানি
জার্মানির বার্লিনে অবস্থিত চ্যারিটি হাসপাতাল ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ ও প্রভাবশালী বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল। এটি শুধুমাত্র একটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানই নয়, বরং চিকিৎসা শিক্ষার এক বিস্ময়কর কেন্দ্র।
বিশেষত্ব
- চিকিৎসা ও শারীরবৃত্তীয় বিষয়ে নোবেল বিজয়ী ৫০%-এর বেশি বিজ্ঞানী এই হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত
- প্রতিষ্ঠিত ১৭১০ সালে
- গবেষণা ও মেডিকেল ট্রেনিংয়ের জন্য বিশ্বের অন্যতম সম্মানজনক স্থান
এখানে একসঙ্গে কাজ করেন চিকিৎসক, গবেষক এবং শিক্ষার্থীরা। গবেষণায় বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়ার ফলে একাধিক যুগান্তকারী চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে এখান থেকেই।
৮. সেবা মেডিকেল সেন্টার, ইসরায়েল
রামাত গানে ১৫০ একরের ক্যাম্পাসজুড়ে গড়ে ওঠা ইসরায়েলের সেবা মেডিকেল সেন্টার কেবল দেশটিরই নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় ও স্বীকৃত হাসপাতাল। আধুনিক প্রযুক্তি, উদ্ভাবনী গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক মানের স্বাস্থ্যসেবার এক অনন্য কেন্দ্র এটি।
বিশেষত্ব
- বছরে প্রায় ২ মিলিয়নের বেশি রোগী এখানে চিকিৎসা নেন
- ১,৯০০ শয্যার সুবিধা
- ১০,০০০ এর বেশি স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসক কাজ করেন এখানে
সেবা মেডিকেল সেন্টার এমন একটি হাসপাতাল যেখানে প্রতিটি রোগীকে ডিজিটাল রেকর্ডিং ও অটোমেটেড মনিটরিং-এর মাধ্যমে নজরদারিতে রাখা হয়। এটি রোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং চিকিৎসার মানোন্নয়ন ঘটায়।
৯. সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল (এসজিএইচ), সিঙ্গাপুর
এশিয়ার স্বাস্থ্যসেবার দিক থেকে সিঙ্গাপুর সবসময়ই এগিয়ে। সেই দেশের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন হাসপাতাল হলো SGH। এটি শুধু একটি হাসপাতাল নয়, বরং সিঙ্গাপুরের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার প্রাণকেন্দ্র।
বিশেষত্ব
- AI ও Machine Learning-নির্ভর রোগ নির্ণয় পদ্ধতি
- ১০০০+ শয্যার সুবিধা
- চিকিৎসক, নার্স ও গবেষকদের একত্রে কাজ করার পরিবেশ
SGH-এর বড় বিশেষত্ব হলো, এটি একটি টারশিয়ারি কেয়ার হাসপাতাল। অর্থাৎ, এটি অন্যান্য হাসপাতাল থেকে রেফার হওয়া জটিল রোগীদের চিকিৎসা দেয়।
১০. ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল জুরিখ (ইউএসজেড), সুইজারল্যান্ড
সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল জুরিখ একটি উচ্চমানের চিকিৎসাকেন্দ্র। এটি শুধু সুইজারল্যান্ডেই নয়, বরং গোটা ইউরোপে পরিচিত এক নাম।
বিশেষত্ব
- সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সঙ্গে যুক্ত
- ৪০টির বেশি স্পেশালাইজড ক্লিনিক
- প্রায় ৮,০০০ চিকিৎসাকর্মী এখানে সেবা দেন
USZ রোগীর জন্য অত্যাধুনিক ইমেজিং, জেনোমিকস, রোবোটিক সার্জারি এবং ক্লিনিকাল ট্রায়াল সুবিধা দেয়। এতে করে একদিকে যেমন উন্নত চিকিৎসা সম্ভব হয়, অন্যদিকে গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।