অনলাইনে শূন্য আয়কর Zero Return জমা দেওয়ার পদ্ধতি


অনলাইনে শূন্য আয়কর Zero Return জমা দেওয়ার প্রধান শর্ত হলো ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (TIN) ধারী ব্যক্তির মোট আয় করমুক্ত সীমার মধ্যে থাকা। প্রতিটি টিআইএন (TIN) ধারীর জন্যই আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক। যদি তাদের কোনো আয় নাও থাকে তবুও শূন্য আয়কর বা Zero Return জমা দিতে হবে।

এটি সরকারের কাছে নাগরিকদের আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রণীত। যাদের আয় করমুক্ত সীমার মধ্যে রয়েছে, তারা সহজেই শূন্য রিটার্ন দাখিল করতে পারেন।

জিরো রিটার্ন বা শূন্য আয়কর কী?

আমরা অনেকেই আয়কর রিটার্ন এবং Zero বা শূন্য আয়কর রিটার্ন নিয়ে বিভ্রান্তিতে পরি। অনেকেই ভাবেন, জিরো বা শূন্য আয়কর রিটার্ন জমা দিতেও অর্থ প্রদান করতে হবে। আসলে বিষয়টি এমন নয়।

মূলত, জিরো বা শূন্য আয়কর রিটার্ন বলতে বোঝায় এমন একটি রিটার্ন যেখানে আপনার আয়কর দায় শূন্য হয়। অর্থাৎ আপনাকে কোনো টাকা জমা দিতে হয় না। শূন্য আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া হয় মূলত আইনগত বাধ্যবাধকতা পূরণের জন্য। যাতে আয়কর দায় থাক বা না থাক, আপনার আয়ের বিবরণ সরকারকে জানানোর জন্য।

যদি কোনো ব্যক্তির ই-টিন থাকে এবং তার আয় করমুক্ত সীমার মধ্যে থাকে, তাহলে তিনি জিরো আয়কর রিটার্ন জমা দিতে পারেন। এছাড়া, কোনো করমুক্ত আয়ের সীমা অতিক্রম করলে, আইন অনুযায়ী আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক হয়।

অর্থাৎ, যে আয় করমুক্ত সীমার মধ্যে থেকে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া হয়, তাকে শূন্য রিটার্ন বা জিরো রিটার্ন বলা হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো কর প্রদানের প্রয়োজন হয় না। আয়, ব্যয়, সম্পদ ও ঋণের সঠিক তথ্য প্রদান করে এ রিটার্ন দাখিল করতে হয়।

টিআইএনধারী যেসব নাগরিকের আয় করমুক্ত সীমার মধ্যে রয়েছে, তাদের শূন্য আয়কর রিটার্ন দাখিল করার অনুমতি রয়েছে।

করমুক্ত আয়ের সীমা নিন্মরূপ

  • নারীদের ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ব্যক্তিদের বার্ষিক আয় ৪ লাখ টাকার কম।
  • প্রতিবন্ধী বা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের বার্ষিক আয় ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকার মধ্যে।
  • যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে বার্ষিক আয় ৫ লাখ টাকার কম।
  • অন্যান্য ব্যক্তিদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

অনলাইনে জিরো রিটার্ন বা শূন্য আয়কর জমা দেওয়ার ধাপ

১. প্রথম ধাপ:

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ই-রিটার্ন পোর্টালে (https://etaxnbr.gov.bd/#/auth/sign-in) লগইন করুন। লগইন করার আগে আয়, ব্যয়, সম্পদ এবং ঋণের প্রয়োজনীয় তথ্য ও নথিপত্র প্রস্তুত রাখুন।

২. রিটার্ন ফর্ম পূরণ:

রিটার্ন ফর্মটি দুইভাবে পূরণ করা যায়—এক পেজের সংক্ষিপ্ত রিটার্ন বা বিস্তারিত মাল্টিপেজ রিটার্ন।

এক পেজের রিটার্ন: এখানে সংক্ষেপে আয়, ব্যয় এবং সম্পদের তথ্য প্রদান করতে হয়। করযোগ্য আয় না থাকলে প্রদেয় কর শূন্য রেখে রিটার্ন দাখিল করা যায়।

মাল্টিপেজ রিটার্ন: এখানে সরবরাহকৃত তথ্যের ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হিসাব নির্ধারণ হয়। করযোগ্য আয় না থাকলে “নো” অপশন সিলেক্ট করুন, যাতে পরবর্তী ধাপে কর সম্পর্কিত সেকশন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।

৩. সম্পত্তি ও ঋণ সংক্রান্ত তথ্য প্রদান:

যাদের সম্পত্তি বা ঋণ রয়েছে, তাদের আইটি১০বি ফর্ম পূরণ করতে হবে। সঠিক তথ্য নিশ্চিত করে ব্যয় এবং আয়কর রেয়াতের তথ্য প্রদান করুন।

৪. সব তথ্য যাচাই:

রিটার্ন ফর্মে দেওয়া তথ্য যাচাই করে সঠিক হলে “সাবমিট রিটার্ন” বাটনে ক্লিক করুন।

সঞ্চয়পত্রে শূন্য আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার পদ্ধতি

সঞ্চয়পত্রের মুনাফা নিয়ে শূন্য আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রধানত বিস্তারিত (ডিটেইল) রিটার্ন ফর্ম ব্যবহার করা হয়। প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপে করযোগ্য আয় রয়েছে কি না, এই প্রশ্নের উত্তরে “ইয়েস” অপশন নির্বাচন করতে হবে। এর ফলে ডানপাশে সক্রিয় হয়ে ওঠা “হেডস অব ইনকাম” থেকে “ইনকাম ফ্রম ফিন্যান্সিয়াল অ্যাসেটস”-এ টিক চিহ্ন দিতে হবে।

রেয়াতের তথ্য প্রদান

পরবর্তী ধাপে “অ্যাডিশনাল ইনফরমেশন” পেজে গিয়ে রেয়াত সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে “ইয়েস” নির্বাচন করতে হবে। একই সঙ্গে আইটি১০বি ফর্মও সক্রিয় রাখতে হবে। এরপর “ইনকাম” পেজে দেখা যাবে “এক্সপেন্ডিচার” ও “রিবেট”সহ অন্যান্য তথ্য সরবরাহের ট্যাব। এখানে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার তথ্য প্রদান করতে হবে।

রেয়াতের হিসাব

“কর রেয়াত” পেজে ইনভেস্টমেন্ট ক্যাটাগরির অধীনে “অ্যাপ্রুভড সঞ্চয়পত্র” নির্বাচন করে বিনিয়োগের তথ্য উল্লেখ করতে হবে। সঞ্চয়পত্রে রেয়াতের সর্বোচ্চ সীমা ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নির্ধারিত। সঞ্চয়পত্রে এর চেয়ে বেশি বিনিয়োগ করলেও রেয়াত হিসেবে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা হিসাব করা হবে।

ব্যয়ের হিসাব

এরপর ব্যয়ের পেজে গিয়ে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে উৎসে কর সংক্রান্ত তথ্য প্রদান করতে হবে। “পেমেন্ট অব ট্যাক্স অ্যাট সোর্স” ঘরে উৎসে করের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।

সম্পত্তি ও দায় বিবরণী

পূর্বে আইটি১০বি সক্রিয় রাখার ফলে সম্পত্তি ও দায় (অ্যাসেটস অ্যান্ড লায়াবিলিটিস) সংক্রান্ত পেজ সক্রিয় থাকবে। এখানে সঞ্চয়পত্রসহ অন্যান্য সম্পদের বিবরণ এবং তাদের অর্থের উৎস উল্লেখ করতে হবে।

আরও পড়ুন: প্রাইজবন্ড ড্র ২০২৫ | ১১৯ তম প্রাইজ বন্ড ড্র’র ফলাফল

সমন্বয় এবং চূড়ান্ত সাবমিশন

সমস্ত তথ্য সঠিকভাবে পূরণ করার পরে “ফান্ড আউটফ্লো” এবং “সোর্স অব ফান্ড” এর পরিমাণের মধ্যে সমতা আনতে হবে। এরপর “সেভ অ্যান্ড কন্টিনিউ” করে পরবর্তী ধাপে যেতে হবে। “ট্যাক্স অ্যান্ড পেমেন্ট” পেজে গিয়ে নিশ্চিত করতে হবে যে প্রদেয় করের পরিমাণ শূন্য হয়েছে।

শেষ ধাপ

পরবর্তী ধাপে “গো টু ই-রিটার্ন” অপশনে গিয়ে পুরো ফর্মটি একবার যাচাই করে নিতে হবে। কোনো ত্রুটি না থাকলে “সাবমিট রিটার্ন” বাটনে ক্লিক করে রিটার্ন জমা দিতে হবে।

সতর্কতা

  • রিটার্ন ফর্ম পূরণে সকল তথ্য সঠিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া জরুরি।
  • প্রদেয় কর শূন্য থাকলেও আয় ও ব্যয়ের তথ্য সঠিকভাবে প্রদান করা।
  • ই-রিটার্ন প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে তথ্য যাচাই করে সাবমিট করুন।

শূন্য আয়কর রিটার্ন দাখিল প্রক্রিয়া সহজ এবং সময় সাশ্রয়ী। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ঘরে বসেই এটি সম্পন্ন করা যায়। তাই করমুক্ত সীমার মধ্যে থাকা ব্যক্তিদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

আয়কর ও শূন্য আয়কর রিটার্ন এর পার্থক্য

বিষয়আয়কর রিটার্নশূন্য আয়কর রিটার্ন
আয়কর পরিশোধকরতে হতে পারেদিতে হয় না
আয়ের পরিমাণকরমুক্ত সীমার উপরে হলেকরমুক্ত সীমার নিচে হলে
উদ্দেশ্যসরকারকে আয় ও করের বিবরণ দেওয়া এবং কর পরিশোধআয়ের বিবরণ দেওয়া, যদিও কোনো কর দিতে হয় না
ব্যবহারিক সুবিধাব্যাংক ঋণ, ভিসা প্রসেসিং, ফিন্যান্সিয়াল ট্রান্সপারেন্সিএকইভাবে ব্যাংক ঋণ, ভিসা প্রসেসিং, সঠিক রেকর্ড রাখা

কেন আয়কর প্রদান করা দরকার

বাংলাদেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের জন্য আয়কর প্রদান শুধু একটি আইনগত বাধ্যবাধকতাই নয়। বরং এটি জাতীয় উন্নয়ন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। দেশে আয়কর প্রদানের সংস্কৃতি ক্রমেই বাড়ছে, তবে এখনো অনেকের মাঝে এ সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে।

আইন মেনে চলার গুরুত্বপূর্ণ অংশ আয়কর

বাংলাদেশের বিদ্যমান আয়কর আইনের আওতায় নির্দিষ্ট পরিমাণ বা তার বেশি আয় হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত কর জমা দিতে হয়। যারা আয় থাকা সত্ত্বেও কর প্রদান করেন না, তারা আইনি ঝুঁকি ও জরিমানার সম্মুখীন হতে পারেন।

রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে প্রত্যক্ষ অবদান

সরকারি বাজেটের বড় একটি অংশ আসে জনগণের দেওয়া কর থেকে। এই রাজস্ব অর্থ ব্যবহৃত হয় দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, সড়ক ও সেতু নির্মাণ, শিক্ষা খাতের প্রসার, স্বাস্থ্যসেবার আধুনিকায়ন এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজে। অর্থাৎ কর প্রদান মানেই রাষ্ট্রের অগ্রগতিতে সরাসরি অংশ নেওয়া।

সম্মানিত করদাতা হিসেবে সুযোগ সুবিধা

নিয়মিত আয়কর জমাদানকারী নাগরিকদের জন্য রয়েছে নানা প্রণোদনা ও সুযোগ। কর রিটার্ন দাখিল করলে ভিসা আবেদন সহজ হয়। ব্যাংক ঋণ গ্রহণে সুবিধা পাওয়া যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে করদাতাদের সরকারিভাবে বিশেষ সম্মাননাও দেওয়া হয়।

আর্থিক স্বচ্ছতা

আয়কর প্রদানের মাধ্যমে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আর্থিক তথ্য রেকর্ডভুক্ত হয়, যা ভবিষ্যতে কোনো ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বা বিনিয়োগে সহায়ক প্রমাণ হতে পারে। এটি ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক স্বচ্ছতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

নাগরিক দায়িত্ব ও নৈতিক কর্তব্য

রাষ্ট্র নাগরিকদের যে সুবিধাগুলো দেয়— যেমন: আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সড়কবাতি, হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সবকিছুই জনগণের দেওয়া করের টাকায় পরিচালিত হয়। তাই কর প্রদান মানে নিজের প্রাপ্য সুবিধাগুলোর খরচ বহনে অংশ নেওয়া।

আয়কর প্রদান শুধু একটি আর্থিক লেনদেন নয়, এটি একজন সচেতন, দায়িত্বশীল নাগরিকের পরিচায়ক। আইন মেনে চলা, জাতীয় উন্নয়নে অবদান এবং ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখনই সময় কর প্রদানে আরও সক্রিয় হওয়ার।


2 thoughts on “অনলাইনে শূন্য আয়কর Zero Return জমা দেওয়ার পদ্ধতি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *