বছরের আলোচিত শব্দ জেন-জি | কারা এই gen-Z

বছরের আলোচিত শব্দ জেন-জি , কারা এই gen-Z সেটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো। জেনারেশন জেডের সংক্ষিপ্ত রূপ হলো জেন-জি। চলতি বছরের আলোচিত ঘটনাগুলোর সূত্র ধরে এই শব্দটি উঠে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রে।

১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যাদের জন্ম, তারাই জেন-জি। ২০২৫ সালের হিসেবে জেন-জি প্রজন্মের সবচেয়ে বড় সদস্যের বয়স এখন ২৮, আর সবচেয়ে ছোটজনের বয়স মাত্র ১৩।

বিভিন্ন জেনারেশন

সাধারণত ২০ থেকে ২৫ বছর সময় ধরে একটি প্রজন্ম গড়ে ওঠে। জেন-জির আগে এসেছে বেবি বুমার্স, জেনারেশন এক্স, মিলেনিয়ালস (জেন ওয়াই) এবং এর পর আসছে জেনারেশন আলফা। ২০১২ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত জন্ম নেওয়া শিশুরাই জেনারেশন আলফার অন্তর্ভুক্ত।

তবে বিগত কয়েক বছরের সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জেন-জি যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে, তা স্পষ্ট। এই প্রজন্ম তাদের ডিজিটাল দক্ষতা, স্বাধীন চিন্তাভাবনা এবং সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণের কারণে অন্য প্রজন্ম থেকে আলাদা।

ডিজিটাল প্রজন্ম জেন-জি

জেন-জি প্রজন্মকে বলা হয় প্রথম ডিজিটাল নেটিভ প্রজন্ম। প্রযুক্তি এদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঙ্গে বেড়ে উঠেছে। এ কারণে এরা পরিচিত নেটিজেন বা হোমল্যান্ড জেনারেশন হিসেবেও।

জেন-জিরা সাধারণত তাদের ঠিক আগের প্রজন্ম, মিলেনিয়ালসদের সঙ্গে তুলনায় আসে। তবে মিলেনিয়ালসদের তুলনায় তারা অনেক বেশি বাস্তববাদী এবং ক্যারিয়ারমুখী। কোভিড-১৯ মহামারি এ প্রজন্মের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। ঘরবন্দি সময়ে অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে তারা নিজেদের দক্ষতা এবং যোগাযোগের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করেছে।

জেন-জি রা কেমন হয় ?

কিছুদিন আগেও জেন-জিদের সম্পর্কে সমাজে নেতিবাচক মন্তব্য প্রচলিত ছিল—তাদের অধৈর্য, অলস কিংবা প্রযুক্তিতে অতিমাত্রায় আসক্ত হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারাই উঠে এসেছে নেতৃত্বের আসনে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়তার কারণে এই প্রজন্ম সমাজ এবং রাজনীতিতে সচেতন ভূমিকা পালন করছে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া এই আন্দোলন দেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে স্থান পেয়েছে।

এছাড়া, বন্যা কিংবা অন্যান্য দুর্যোগকালীন সময়ে এই প্রজন্ম তাদের প্রযুক্তিজ্ঞান ব্যবহার করে ত্রাণ কার্যক্রম এবং অনলাইন প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

জেন-জি GEN- Z

ফ্যাসন সচেতন

জেন-জির ফ্যাশনে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এই প্রজন্ম আরামদায়ক এবং ইউনিসেক্স পোশাককে প্রাধান্য দেয়। স্কিনি প্যান্টস কিংবা বডিকন পোশাকের বদলে ওভারসাইজড এবং ঢিলেঢালা পোশাক এখন জেন-জিদের প্রিয়।

তারা পুরোনো পোশাক বা শাড়িকে নতুন উপকরণ দিয়ে পুনরায় সাজিয়ে ফ্যাশনে নতুন সংজ্ঞা তৈরি করছে। এই সৃজনশীলতাই তাদের ফ্যাশনকে আলাদা করে তুলেছে।

ব্যতিক্রমী ভাষা ব্যবহার

জেন-জিরা তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। দৈনন্দিন কথোপকথনে তারা এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করে, যা পুরোনো প্রজন্মের অনেকেই বুঝতে পারে না। যেমন—ডেলুলু, গোট, পুকি, ব্রেডক্রাম্বিং, ক্যাসপারিং, জোম্বিয়িং প্রভৃতি।

তাদের দ্রুত চিন্তাশক্তি এবং নতুন কিছুকে গ্রহণ করার ক্ষমতা অনেক সময় পুরোনো প্রজন্মের কাছে বোধগম্য নয়। তবে সমালোচনার বদলে এই প্রজন্মের সৃজনশীলতা এবং ভবিষ্যৎমুখী দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।

জেনারেশন জি (জেন-জি) এর বৈশিষ্ট্যসমূহ:

  • ডিজিটাল নেটিভ: তারা ইন্টারনেট, স্মার্টফোন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে বড় হয়েছে, তাই প্রযুক্তির সাথে তাদের সম্পর্ক অত্যন্ত স্বাভাবিক ও গভীর।
  • তথ্য-সচেতন: যেকোনো বিষয়ের গভীরে যাওয়ার জন্য দ্রুত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে দক্ষ।
  • বহুমুখী দক্ষতা: একই সময়ে বিভিন্ন কাজ (মাল্টিটাস্কিং) করতে পারা তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
  • পরিবেশ সচেতন: জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ রক্ষা এবং টেকসই উন্নয়ন নিয়ে তাদের আগ্রহ বেশি।
  • ব্যক্তিগত অভিব্যক্তির প্রতি মনোযোগী: নিজস্বতা এবং ব্যক্তিগত পছন্দের প্রতি তারা খুব সচেতন। ফ্যাশন, সংগীত ও কাজের ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব স্টাইল থাকে।
  • সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন: সামাজিক ন্যায়বিচার, বৈষম্য এবং মানবাধিকার বিষয়ক ইস্যুতে তারা স্পষ্ট মত প্রকাশ করে।
  • তৎক্ষণাৎ ফলাফল প্রত্যাশা: প্রযুক্তির সুবিধার কারণে তারা দ্রুত ফলাফল পেতে অভ্যস্ত।
  • উদ্যোক্তা মানসিকতা: নতুন ধারণা নিয়ে কাজ করতে এবং নিজস্ব উদ্যোগ গড়ে তুলতে তারা উৎসাহী।
  • বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তি-প্রেমী: তারা বিভিন্ন সংস্কৃতি, ভাষা এবং সম্প্রদায়ের প্রতি উন্মুক্ত এবং সহনশীল।
  • শিক্ষা ও কর্মের মধ্যে ভারসাম্য খোঁজা: কর্মজীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে সমতা বজায় রাখতে তারা আগ্রহী।
  • সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী: তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন কিছু তৈরি করতে পছন্দ করে এবং সৃজনশীলতাকে গুরুত্ব দেয়।
  • মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন: মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা নিয়ে তারা খোলামেলা আলোচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
  • বিনোদনের পরিবর্তনশীল পছন্দ: স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম, গেমিং এবং ইন্টারেক্টিভ কন্টেন্টে তাদের আগ্রহ বেশি।
  • আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি: গ্লোবালাইজেশনের প্রভাবের কারণে তারা বিশ্বব্যাপী সংযুক্ত এবং বৈশ্বিক সমস্যাগুলোতে আগ্রহী।
  • টেক-সেভি প্রজন্ম: নতুন প্রযুক্তি দ্রুত গ্রহণ এবং ব্যবহার করার ক্ষেত্রে তারা অত্যন্ত পারদর্শী।

বয়সের ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রজন্ম

প্রজন্মের নামজন্ম বছর
সাইলেন্ট জেনারেশন১৯২৮ – ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দ
বেবি বুমার১৯৪৬ – ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দ
জেনারেশন এক্স১৯৬৫ – ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ
মিলেনিয়ালস বা জেনারেশন ওয়াই১৯৮১ – ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দ
জেনারেশন জেড১৯৯৭ – ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ
জেনারেশন আলফা২০১৩ – বর্তমান (চলবে ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ অবধি)

সময়ের সাথে মানুষের জীবনধারা, চিন্তাভাবনা ও প্রযুক্তি গ্রহণের ধরন বদলে যায়। জন্ম সালের ভিত্তিতে মানুষের এই পরিবর্তনকে চিহ্নিত করতে সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন প্রজন্ম বা Generation ভাগ করেছেন। প্রতিটি প্রজন্মের রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও জীবনদর্শন, যা গড়ে উঠেছে নির্দিষ্ট সময়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত প্রেক্ষাপটে।

চলুন দেখে নিই বয়সের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত বিভিন্ন প্রজন্মের পরিচয়:

সাইলেন্ট জেনারেশন (Silent Generation)

জন্ম বছর: ১৯২৮ – ১৯৪৫

প্রধান বৈশিষ্ট্য:

  • যুদ্ধ ও মহামন্দার কঠিন সময় অতিক্রম করা।
  • পরিশ্রম, সংযম এবং আনুগত্যকে জীবনদর্শনের অংশ করা।
  • পরিবার ও স্থিতিশীলতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ।

বেবি বুমার (Baby Boomers)

জন্ম বছর: ১৯৪৬ – ১৯৬৪

প্রধান বৈশিষ্ট্য:

  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জন্মহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া সময়ের প্রতিনিধিত্ব।
  • অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামাজিক আন্দোলন ও ক্যারিয়ার গড়ার উপর গুরুত্বারোপ।
  • আত্মনির্ভরশীলতা ও অর্জনমুখী মনোভাবের অধিকারী।

জেনারেশন এক্স (Generation X)

জন্ম বছর: ১৯৬৫ – ১৯৮০

প্রধান বৈশিষ্ট্য:

  • প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো প্রথম প্রজন্ম।
  • স্বাধীনচেতা, বাস্তববাদী এবং উদ্ভাবনী মনোভাব।
  • পেশাগত এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য তৈরির প্রচেষ্টা।

মিলেনিয়ালস বা জেনারেশন ওয়াই (Millennials or Gen Y)

জন্ম বছর: ১৯৮১ – ১৯৯৬

প্রধান বৈশিষ্ট্য:

  • ইন্টারনেট, স্মার্টফোন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে বেড়ে ওঠা।
  • প্রযুক্তিনির্ভর জীবনধারা এবং বৈচিত্র্যময় চিন্তাধারা।
  • মানসিক স্বাস্থ্য ও জীবনের গুণগত মানের উপর বাড়তি গুরুত্ব প্রদান।

জেনারেশন জেড (Generation Z)

জন্ম বছর: ১৯৯৭ – ২০১২

প্রধান বৈশিষ্ট্য:

  • ছোটবেলা থেকেই ইন্টারনেট ও ডিজিটাল মাধ্যমের সাথে গভীর পরিচয়।
  • দ্রুত তথ্য গ্রহণ ও নতুন প্রযুক্তি আত্মস্থ করার দক্ষতা।
  • সামাজিক ন্যায়বিচার ও বৈচিত্র্যের প্রতি উচ্চ সংবেদনশীলতা।

জেনারেশন আলফা (Generation Alpha)

জন্ম বছর: ২০১৩ – বর্তমান (চলবে ২০২৫ অবধি)

প্রধান বৈশিষ্ট্য:

  • প্রথম প্রজন্ম যারা পুরোপুরি ডিজিটাল দুনিয়ায় বড় হচ্ছে।
  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR) এবং উদ্ভাবনী প্রযুক্তির সাথে অভ্যস্ত।
  • শিক্ষাক্ষেত্রে আরও বেশি প্রযুক্তিনির্ভর ও বিশ্বায়িত চিন্তাধারার অধিকারী।

সংক্ষেপে বলা যায়, প্রতিটি প্রজন্ম তাদের সময়ের নির্দিষ্ট সামাজিক, প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ছাপ বহন করে। বয়সের ভিত্তিতে এই বিভাজন মানব ইতিহাসের নানা পর্যায়ে সমাজের বিবর্তনকে বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়।

Leave a Comment