সারা বিশ্বের ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য নদ নদী। আঁকার আকৃতি দৈর্ঘ্য গভীরতা একটি থেকে অন্যটি ভিন্ন ভিন্ন। বিশ্বের দীর্ঘতম নদ-নদীর কথা আসলেই সর্বপ্রথম মাথায় আসে নীলনদের কথা। নীলনদ হচ্ছে বিশ্বের দীর্ঘতম নদ।
প্রাচীনকাল থেকেই মানব সভ্যতা নদী কেন্দ্রিক। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে হাজারো সভ্যতা। আবার এই নদীর কারণেই বিলীন হয়ে গেছে শত শত সভ্যতা। এগুলো অনেকটাই আজও আমাদের অজানা।
বিশ্বের সকল সভ্যতা গুলো গড়ে উঠেছিল কোন না কোন নদীর উপত্যকায়। একটি নদী সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আজ আমরা জানবো বিশ্বের দীর্ঘতম নদ-নদী সম্পর্কে।
বিশ্বের দীর্ঘতম ১০ নদীর তালিকা
- ১. নীল নদ
- ২. আমাজন নদী
- ৩. ইয়াংজি নদী
- ৪. মিসিসিপি–মিজৌরি নদী
- ৫. ইয়েনিসেই নদী
- ৬. হোয়াংহো নদী
- ৭. ওব নদী
- ৮. রিও ডি লা প্লাতা
- ৯. কঙ্গো নদী
- ১০. আমুর নদী
বিশ্বের দীর্ঘতম নদীগুলোর দৈর্ঘ্য
নদীর নাম | দৈর্ঘ্য (কিলো মিটার) |
নীল নদ – | ৬ হাজার ৬৯৫ |
আমাজন নদী – | ৬ হাজার ৪০০ |
ইয়াংজি নদী – | ৬ হাজার ৩০০ |
মিসিসিপি–মিজৌরি নদী – | ৫ হাজার ৯৭১ |
ইয়েনিসেই নদী – | ৫ হাজার ৫৩৯ |
হোয়াংহো নদী – | ৫ হাজার ৪৬৪ |
ওব নদী – | ৫ হাজার ৪১০ |
রিও ডি লা প্লাতা – | ৪ হাজার ৮৮০ |
কঙ্গো নদী – | ৪ হাজার ৭০০ |
আমুর নদী – | ৪ হাজার ৪৪৪ |
নীল নদ
বিশ্বের দীর্ঘতম নদী নীল নদের অবস্থান উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায়। নীলনদের দৈর্ঘ্য ৬,৬৯৫ কিলোমিটার প্রায়।
আফ্রিকার বিখ্যাত নদী নীলনদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল মিশরীয় সভ্যতা। নীলনদ আফ্রিকা তথা পুরো বিশ্বের দীর্ঘতম জলাধার। যাতায়াত চাষাবাদ ও সুপেও পানির জন্য এ অঞ্চলের মানুষ এই নদের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। যার কারণে এই নদীকে আফ্রিকার জন্য আশীর্বাদ বলা হয়।
নীলনদ শুধু মিশরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আফ্রিকা মহাদেশের ১১ টি দেশের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে এই নদ। যে দেশগুলোর মধ্য দিয়ে এটি প্রবাহিত হয়েছে সে দেশের নাম গুলো হল –
- মিশর
- কঙ্গো
- সুদান
- ইরিত্রিয়া
- ইথিওপিয়া
- দক্ষিণ সুদান
- কেনিয়া
- উগান্ডা
- বুরুন্ডি
- রুয়ান্ডা
- তানজানিয়া
নীলনদের দুটি উপনদী রয়েছে।
উপনদী গুলোর নাম হল
- নীলাভ নীলনদ
- শ্বেত নীলনদ
এরমধ্যে শ্বেত নীল নদের আয়তন সবচেয়ে বেশি। যা আফ্রিকার মধ্যভাগের হ্রদ অঞ্চল থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। এটি দক্ষিণে রুয়ান্ডা থেকে উৎপন্ন হয়ে উত্তরের দিকে তানজানিয়া, লেক ভিক্টোরিয়া, উগান্ডা হয়ে দক্ষিণ সুদানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
নীলাভ নীলনদ ইথিওপিয়ার তানা হ্রদ থেকে উৎপত্তি লাভ করে পূর্ব দিকে সুদানের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে। এই দুটি উপনদী সুদানে প্রবেশের মাধ্যমে সুদানের রাজধানী খারতুমে এসে পুনরায় মিলিত হয়েছে। এরপর সুদান থেকে মিশরের মধ্য দিয়ে বিশাল বদ্বীপ সৃষ্টি করে নীলনদ ভূমধ্যসাগরে গিয়ে পতিত হয়েছে।
আফ্রিকার ১১ টি দেশের মধ্য দিয়ে এই নোট বয়ে চললেও এই নদের উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল দেশ মিশর।মিশরের মরুভূমির মধ্যভাগ দিয়ে বয়ে চলেছে এই নদ। ফলে এই নদের আশেপাশের ভূমি হয়েছে উর্বর। তাই কৃষি ও যাতায়াতের উপর এই অঞ্চলের বাসিন্দারা এই নদের উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল।
মিশরের পর এই নদের উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল দেশ সুদান। সুদানের রাজধানী খারতুম গড়ে উঠেছে নীলনদের অববাহিকায়। সুদানিরদের কাজ কাছে নীলনদ আল নীল, বাহার আল নীল, আল বাহার সহ বেশ কয়েকটি নামে পরিচিত।
নীলনদের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা পৃথিবীর অন্য কোন নদ বা নদীর নেই। এই কথাটি বলেছিলেন বিখ্যাত গণিতবিদ ও চিকিৎসাবিদ ইবনে সিনা। নীলনদের এসব বৈশিষ্ট্য গুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এর পানি প্রবাহ ব্যবস্থা।
তবে এর সবচেয়ে বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য হলো পৃথিবীর সকল নদীর পানি যখন কমে যায় নীল নদের পানি তখন বৃদ্ধি পায়। আর পৃথিবীর সকল নদনদীর পানি যখন বৃদ্ধি পায়, তখন নীল নদের পানি কমে যায়।
নীলনদকে প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় বলা হতো ইতেরু।তবে অনেকের মতে নীল শব্দটি এসেছে সেমিটিক শব্দ নাহারু থেকে। যার অর্থ প্রবাহমান উপত্যকা। প্রাচীনকালে বছরের সবচেয়ে উষ্ণতম সময়ে নীলনদ বন্যায় প্লাবিত হতো। এ কারণে গ্রীক ও প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে এটি অত্যন্ত রহস্যময় ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হতো।
আমাজন নদী
দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম নদী আমাজন।পানি প্রবাহের দিক দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদী আমাজন। এর দীর্ঘ প্রায় ৬,৪০০ কিলোমিটার।
আমাজন নদীর উৎস পেরুর আন্দেস পর্বতমালায়। সেখান থেকে এটি উত্তরের দিকে প্রবাহিত হয়ে পূর্ব দিকে মোড় নিয়ে ব্রাজিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত আটলান্টিক মহাসাগরে মিশে যায়।
আমাজন অববাহিকা দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, যেখানে ব্রাজিল ও পেরুর বৃহৎ অংশ ছাড়াও বলিভিয়া, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া এবং ভেনেজুয়েলার অংশ অন্তর্ভুক্ত।
এই অঞ্চলে বিশ্বের বৃহত্তম রেইনফরেস্ট বা বৃষ্টিবহুল অরণ্য অবস্থিত, যা প্রকৃতির অপার বিস্ময়ের অন্যতম। বিশ্বের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ উদ্ভিদের প্রজাতি এখানে জন্মায়।
বানর, অলস ভালুক, পিপীলিকা খেকো, আর্মাডিলো, বিশাল আকৃতির অজগর সাপ (অ্যানাকোন্ডা), টোকান পাখি এবং বিশ্বের বৃহত্তম কাঠবিড়ালি সদৃশ প্রাণী ক্যাপিবারার মতো প্রাণীদের দেখা মেলে। নদীতে রয়েছে ভয়ঙ্কর মাংসাশী মাছ পিরানহাসহ নানা প্রজাতির জলজ প্রাণী।
অ্যামাজন অঞ্চলে লাখো মানুষ বসবাস করে। বিশেষ করে ব্রাজিলের বেলেম, মানাউস ও সান্তারেমের মতো শহরগুলো ক্রমশ উন্নত হচ্ছে এবং জনসংখ্যা বাড়ছে।
এক সময় এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রায় ৭ মিলিয়ন আদিবাসী ভারতীয় বাস করতেন। তবে ১৫০০ সালের দিকে ইউরোপীয়দের আগমনের পর অনেককে দাসত্বে বাধ্য করা হয় এবং তাঁদের ব্রাজিল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
এছাড়া ইউরোপীয়দের দ্বারা আনা নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে বহু আদিবাসী মারা যান। ১৯৯০-এর দশকে এসে অ্যামাজন অঞ্চলে মাত্র ৬ লাখ আদিবাসীর অস্তিত্ব টিকে ছিল, যাদের বেশিরভাগই প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাস করেন।
অ্যামাজন নদী এবং এর আশপাশের অঞ্চলের পরিবেশগত ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। এটি শুধু দক্ষিণ আমেরিকার নয়, বরং পুরো বিশ্বের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ইয়াংজি নদী
চীনের সবচেয়ে দীর্ঘতম এবং এশিয়ার বৃহত্তম নদী ইয়াংজি যার দৈর্ঘ্য ৬ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। এটি দেশটির খাদ্য ও অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চীনে ভোগ্য মাছের প্রায় অর্ধেক এবং মোট চাল উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশই আসে এই নদীর অববাহিকা থেকে। এছাড়া, কৃষি ও শিল্প খাতে এর বিশাল ভূমিকা রয়েছে, যা চীনের সামগ্রিক অর্থনীতির প্রায় ৪০% জোগান দেয়।
তবে এই গুরুত্বপূর্ণ নদী ক্রমশ সংকটের মুখে পড়ছে। অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে জলজ ও স্থলজ প্রাণীর জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে। নদীর দূষণ এবং অপরিকল্পিত ব্যবহারের কারণে ইয়াংজির জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। এর অন্যতম দুঃখজনক উদাহরণ হলো ইয়াংজি নদীর ডলফিন, যা ২০০২ সালের পর থেকে আর দেখা যায়নি এবং বর্তমানে এটি বিলুপ্ত বলে ধারণা করা হয়।
নদী রক্ষায় বিভিন্ন সংস্থা ও পরিবেশবিদরা চীনে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরও বৃহৎ উদ্যোগের প্রয়োজন। চীনের শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক বিকাশের সাথে সাথে ইয়াংজি নদী ও সংলগ্ন হ্রদগুলোর দূষণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
বিশেষত, বৃহৎ আকারের মাছ ও শূকর খামারের বর্জ্য এবং শিল্প কারখানার রাসায়নিক বর্জ্যের কারণে নদীর পানির গুণমান আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছেছে।
দূষণের পাশাপাশি বাঁধ নির্মাণও ইয়াংজি নদীর অন্যতম বড় সমস্যা। ১৯৫০ সাল থেকে এ পর্যন্ত নদীর অববাহিকায় ৫০,০০০-এরও বেশি বাঁধ তৈরি করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। এসব বাঁধ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করছে, যার ফলে জলজ প্রাণী ও স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ‘থ্রি গর্জেস ড্যাম’ নির্মাণের সময় ১৩টি বড় শহর, ১৪০টি শহরতলি এবং ৩২৬টি গ্রাম সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিমজ্জিত হয়। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে ১০ লাখেরও বেশি মানুষকে তাদের বসতভিটা ছেড়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে হয়।
এখন জলবায়ু পরিবর্তন নতুন এক সংকট নিয়ে হাজির হয়েছে। ইয়াংজি অববাহিকায় খরা, বন্যা এবং চরম আবহাওয়া ক্রমেই বাড়ছে, যা নদীর হ্রদগুলো শুকিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করছে।
মিসিসিপি–মিজৌরি নদী
উত্তর আমেরিকার দীর্ঘতম নদী ব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত মিসিসিপি-মিজৌরি নদী। এই বিশাল নদী প্রবাহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈচিত্র্যকে স্পর্শ করে প্রবাহিত হয়।
মিসিসিপি নদী ও এর প্রধান উপনদী মিজৌরি একত্রে প্রায় ৫,৯৭১ কিলোমিটার বিস্তৃত, যা একে বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘতম নদীগুলোর তালিকায় স্থান দিয়েছে।
মিসিসিপি নদীর উত্সস্থল মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের লেক ইতাস্কা, যেখান থেকে এটি দক্ষিণমুখী যাত্রা শুরু করে এবং দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মেক্সিকো উপসাগরে গিয়ে মিশে।
অপরদিকে, মিজৌরি নদীর উত্স মন্টানা রাজ্যের রকি পর্বতমালা, যেখান থেকে এটি প্রবাহিত হয়ে মিসিসিপি নদীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়।
এই বিশাল নদী ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন, কৃষি ও অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদীটি শুধু জলপথ পরিবহন ব্যবস্থাকে সহজ করে না, এটি আশেপাশের অঞ্চলের কৃষিকাজেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
নদী তীরবর্তী শহরগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবেও এটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নদী গবেষকদের মতে, মিসিসিপি-মিজৌরি নদীর ভূমিকা পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অনস্বীকার্য। তবে জলবায়ু পরিবর্তন ও দুষণের কারণে নদী ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত বিশেষজ্ঞরা।
ইয়েনিসেই নদী
মঙ্গোলিয়ার পাহাড়ি এলাকা থেকে উৎপত্তি হয়ে উত্তরের দিকে প্রবাহিত ইয়েনিসেই নদী বিশাল সাইবেরিয়ান ভূখণ্ড অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত আর্কটিক মহাসাগরের কারা সাগরে মিলিত হয়েছে।
এই দীর্ঘ জলপথের উৎপত্তিস্থল রাশিয়ার ক্রিজিল শহরের নিকটে, যেখানে এর প্রধান দুটি শাখানদী বাই-খেম (পূর্ব সায়ান পর্বত থেকে উৎপন্ন) এবং কা-খেম (মঙ্গোলিয়া থেকে উৎপন্ন) মিলিত হয়েছে।
ইয়েনিসেই নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৫ হাজার ৫৩৯ কিলোমিটার। এটি রাশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী, যা বিশাল ভূভাগের পানি নিষ্কাশনের কাজ করে।
এর অন্যতম প্রধান উপনদী হচ্ছে আঙ্গারা নদী, যা বিশ্বের গভীরতম স্বাদু পানির হ্রদ বাইকাল লেকের পানি বহন করে এবং রাশিয়ার স্ত্রেলকা শহরের নিকটে ইয়েনিসেইতে এসে মিলিত হয়।
নদীটির গড় গভীরতা প্রায় ৪৫ ফুট এবং এর মোট অববাহিকা এলাকা প্রায় ২৫,৮০,০০০ বর্গকিলোমিটার। এই বিশাল প্রবাহমান নদী অঞ্চলটি শুধু ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্য নয়, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
হোয়াংহো নদী
চীনের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে হোয়াংহো নদী। এই নদী শুধু একটি ভৌগোলিক সীমানা নয়, এটি চীনের সভ্যতার উৎপত্তিস্থল এবং বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী।
তবে একদিকে যেমন হোয়াংহো চীনের সমৃদ্ধির প্রতীক, অন্যদিকে এটি দেশটির এক গভীর বেদনার কারণও বটে।
প্রাচীন চীনে হোয়াংহো নদী প্রায়শই ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করত। এ কারণে এটি “চীনের দুঃখ” নামে পরিচিত ছিল। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, অন্তত ছাব্বিশবার নদীটির গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে, যার ফলে চীনা জনগণের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। এ ধরনের দুর্যোগ বহু মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে, ধ্বংস করেছে জনপদ, কৃষিজমি ও সম্পদ।
হোয়াংহো নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল চীনের প্রাচীনতম সভ্যতা। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রায় চার হাজার বছর আগে এই নদীর দুই তীরে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস শুরু করে। ধীরে ধীরে এখানেই গড়ে ওঠে জনবসতি, কৃষিনির্ভর সমাজ এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের কেন্দ্র। তাই একে চীনের মাতৃনদী হিসেবেও অভিহিত করা হয়।
হোয়াংহো নদীকে “পীত নদী” বা “হলুদ নদী” বলা হয়। কারণ, এর পানিতে প্রচুর পরিমাণে বালি ও পলিমাটি মিশ্রিত থাকে, যা একে হলুদ রঙ ধারণ করতে বাধ্য করে।
চীনের দ্বিতীয় দীর্ঘতম এবং এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম নদীটি প্রায় ৫,৪৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অবশেষে পীত সাগরে মিশেছে। এটি চীনের মোট ৯টি প্রদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
ওব নদী
রাশিয়ার সাইবেরিয়ার পশ্চিম অংশে অবস্থিত ওব নদী দেশটির চতুর্থ বৃহত্তম নদী হিসেবে পরিচিত। এটি দক্ষিণ-পশ্চিম সাইবেরিয়ার আলতাই পর্বতমালার উত্তর ঢালে, মঙ্গোলিয়ার সীমানার কাছে উৎপত্তি লাভ করেছে।
প্রায় ৫ হাজার ৪১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী শুরুতে উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয় এবং পরে ইর্তিশ নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে উত্তর মহাসাগরের একটি অংশ ওব উপসাগরে গিয়ে পতিত হয়।
ওব নদী ও তার উপনদীগুলোর সম্মিলিত নদীবিধৌত এলাকার আয়তন প্রায় ২৬ লক্ষ বর্গকিলোমিটার, যা সাইবেরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত।
ওব নদী প্রধানত কাঠ ও শস্য পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়, যা সাইবেরিয়ার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে শীতকালে তীব্র ঠান্ডার কারণে নদীর পানি বরফে পরিণত হয়, ফলে নৌপরিবহন সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
ওব নদীর উৎসের কাছে বেশ কয়েকটি শিল্পশহর গড়ে উঠেছে, যেখানে নদীর পানিকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। পাশাপাশি, নদীর উপর একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপিত হয়েছে, যা ওই অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রিও ডি লা প্লাতা
রিও ডি লা প্লাতা নদী দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলধারা। এটি আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ের সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত এবং প্রায় ৪,৮৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অবশেষে আটলান্টিক মহাসাগরে মিশেছে।
রিও ডি লা প্লাতা মূলত উরুগুয়ে নদী ও পরাগুয়ে নদীর সংযোগস্থল থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এটি বিশ্বের অন্যতম প্রশস্ত মোহনা, যা কিছু স্থানে প্রায় ২২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। এই নদী দক্ষিণ আমেরিকার বাণিজ্যিক ও পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নদীটির তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছে বুয়েনস আয়ার্স ও মন্টেভিডিওর মতো বৃহৎ বন্দরনগরী, যা দক্ষিণ আমেরিকার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এছাড়া, নদীটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
রিও ডি লা প্লাতা শুধু বাণিজ্যিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি একটি প্রধান পর্যটন আকর্ষণ হিসেবেও পরিচিত। নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে রয়েছে দর্শনীয় স্থান, সুন্দর সমুদ্রসৈকত ও পরিবেশগতভাবে সমৃদ্ধ অঞ্চল, যা প্রচুর পর্যটককে আকৃষ্ট করে।
কঙ্গো নদী
কঙ্গো নদী মধ্য আফ্রিকার অন্যতম প্রধান নদী, যা প্রায় ৪,৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এটি আফ্রিকার দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী এবং পানিপ্রবাহের দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী নদীগুলোর একটি।
কঙ্গো নদী মধ্য আফ্রিকার গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এবং এর বিস্তীর্ণ অববাহিকা বিভিন্ন দেশের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত। এই নদী প্রধানত গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র ও কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের ভূখণ্ডে প্রবাহিত হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে পতিত হয়েছে।
কঙ্গো নদী আফ্রিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলপথ, যা বাণিজ্য, যাত্রী ও কার্গো পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। নদীটি আশপাশের জনপদগুলোর কৃষি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এর জলবিদ্যুৎ উৎপাদনও উল্লেখযোগ্য, যা কঙ্গো গ্র্যান্ড ইনগা বাঁধ প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহে ভূমিকা রাখছে।
এই নদী পৃথিবীর অন্যতম বৈচিত্র্যময় পরিবেশ ধারণ করে, যেখানে অসংখ্য বিরল প্রাণী ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব রয়েছে। কঙ্গো অববাহিকা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেইনফরেস্টকে রক্ষা করে, যা বৈশ্বিক জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আমুর নদী
আমুর নদী পূর্ব এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী, যা রাশিয়া, চীন ও মঙ্গোলিয়ার মধ্যে অবস্থিত। এই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪,৪৪৪ কিলোমিটার, যা একে বিশ্বের দীর্ঘতম নদীগুলোর একটি হিসেবে পরিচিত করেছে।
আমুর নদী মঙ্গোলিয়ার খান খেন티 পর্বতমালার কাছাকাছি উৎপত্তি লাভ করে এবং রাশিয়া ও চীনের মধ্যে প্রাকৃতিক সীমানা তৈরি করে। এটি অবশেষে ওখোটস্ক সাগরের সঙ্গে মিলিত হয়।
আমুর নদী দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও পরিবহন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। নদীটি মাছ ধরার জন্য বিখ্যাত এবং এটি কৃষি ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যও ব্যবহৃত হয়।
আমুর নদীর অববাহিকা একটি সমৃদ্ধ পরিবেশ ও বৈচিত্র্যময় প্রাণীজগতের আবাসস্থল। এখানে বিরল প্রজাতির মাছ, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণী পাওয়া যায়, যা এই নদীকে পরিবেশগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।