যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump)। ধনকুবের পরিবারে জন্ম নেওয়া ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বিশেষ পরিচিতি পান ২০১৭ সালে, যখন তিনি ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। ২০২৪ সালে তিনি পুনরায় ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
ট্রাম্পের বাবা ফ্রেড ট্রাম্প নিউইয়র্কের আবাসন ব্যবসায়ী ছিলেন, আর মা মেরি ট্রাম্প ছিলেন স্কটিশ বংশোদ্ভূত। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে ট্রাম্প ছিলেন চতুর্থ। ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল স্বভাবের কারণে তাঁকে নিউইয়র্ক মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করা হয়। ১৯৬৮ সালে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ারটন স্কুল থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
স্নাতক শেষে বাবার ব্যবসায় যোগ দিয়ে ট্রাম্প ধীরে ধীরে হোটেল, গলফ কোর্স, বহুতল ভবন এবং ক্যাসিনো ব্যবসায় যুক্ত হন। ব্যবসায়িক খ্যাতি অর্জনের পাশাপাশি তিনি জনপ্রিয় টিভি শো দ্য অ্যাপ্রেনটিস এর মাধ্যমে শোবিজ দুনিয়ায় সেলিব্রিটি হয়ে ওঠেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এর রাজনীতিতে আগমন
ট্রাম্পের রাজনৈতিক যাত্রা ২০১৫ সালে শুরু হয়, যখন তিনি আচমকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন। প্রথমে অনেকেই তাঁর প্রার্থিতাকে গুরুত্ব দেননি। কিন্তু ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করে ট্রাম্প প্রমাণ করেন তিনি কেবল ধনকুবের বা টিভি তারকা নন, একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদও।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তিনবার বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রী চেক মডেল ইভানা ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয় ১৯৯২ সালে। এরপর মার্লা ম্যাপলসের সঙ্গে ১৯৯৩ সালে বিয়ে এবং ১৯৯৯ সালে বিচ্ছেদ ঘটে। তৃতীয় স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্প একজন মডেল, যিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি। ট্রাম্প পাঁচ সন্তানের পিতা।
ট্রাম্প সব সময় আলোচনার কেন্দ্রে থাকতে পছন্দ করেন। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তাঁর অভিবাসননীতি, মুসলিম নিষেধাজ্ঞা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং নারী অধিকার নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য সমালোচনার ঝড় তোলে। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগও ওঠে। নির্বাচনে জয়লাভের পর রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ নিয়েও তদন্ত শুরু হয়।
ট্রাম্পের প্রশাসন তাঁর নির্বাহী আদেশ এবং বিতর্কিত নীতির জন্য বেশ সমালোচিত হয়েছে। মুসলিম নিষেধাজ্ঞাসহ বেশ কয়েকটি নির্বাহী আদেশ আদালতে বাধার সম্মুখীন হয়। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনে ট্রাম্প প্রায়শই চাপের মুখে পড়েন। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বারবার পদত্যাগের কারণে তাঁর নেতৃত্বে অস্থিরতা দেখা দেয়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব, যিনি জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। ধনকুবের থেকে শোবিজ তারকা, সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট—ট্রাম্পের জীবন এক অনন্য ও বিতর্কমুখর অধ্যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের তালিকা
ক্রম | প্রেসিডেন্টের নাম | সময়কাল |
১ম | জর্জ ওয়াশিংটন | ১৭৮৯–১৭৯৭ |
২য় | জন অ্যাডামস | ১৭৯৭–১৮০১ |
৩য় | থমাস জেফারসন | ১৮০১–১৮০৯ |
৪র্থ | জেমস ম্যাডিসন | ১৮০৯–১৮১৭ |
৫ম | জেমস মনরো | ১৮১৭–১৮২৫ |
৬ষ্ঠ | জন কুইন্সি অ্যাডামস | ১৮২৫–১৮২৯ |
৭ম | অ্যান্ড্রু জ্যাকসন | ১৮২৯–১৮৩৭ |
৮ম | মার্টিন ভ্যান বিউরেন | ১৮৩৭–১৮৪১ |
৯ম | উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসন | ১৮৪১ (মাত্র এক মাস) |
১০ম | জন টাইলার | ১৮৪১–১৮৪৫ |
১১তম | জেমস কে. পল্ক | ১৮৪৫–১৮৪৯ |
১২তম | জ্যাকারি টেইলর | ১৮৪৯–১৮৫০ |
১৩তম | মিলার্ড ফিলমোর | ১৮৫০–১৮৫৩ |
১৪তম | ফ্রাঙ্কলিন পিয়ার্স | ১৮৫৩–১৮৫৭ |
১৫তম | জেমস বুখানান | ১৮৫৭–১৮৬১ |
১৬তম | আব্রাহাম লিঙ্কন | ১৮৬১–১৮৬৫ |
১৭তম | অ্যান্ড্রু জনসন | ১৮৬৫–১৮৬৯ |
১৮তম | ইউলিসিস এস. গ্রান্ট | ১৮৬৯–১৮৭৭ |
১৯তম | রাদারফোর্ড বি. হেইস | ১৮৭৭–১৮৮১ |
২০তম | জেমস এ. গারফিল্ড | ১৮৮১ (মারা যান) |
২১তম | চেস্টার এ. আর্থার | ১৮৮১–১৮৮৫ |
২২তম | গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড | ১৮৮৫–১৮৮৯ |
২৩তম | বেঞ্জামিন হ্যারিসন | ১৮৮৯–১৮৯৩ |
২৪তম | গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড (দ্বিতীয়বার) | ১৮৯৩–১৮৯৭ |
২৫তম | উইলিয়াম ম্যাককিনলি | ১৮৯৭–১৯০১ |
২৬তম | থিওডোর রুজভেল্ট | ১৯০১–১৯০৯ |
২৭তম | উইলিয়াম হাওয়ার্ড টাফ্ট | ১৯০৯–১৯১৩ |
২৮তম | উড্রো উইলসন | ১৯১৩–১৯২১ |
২৯তম | ওয়ারেন জি. হার্ডিং | ১৯২১–১৯২৩ |
৩০তম | ক্যালভিন কুলিজ | ১৯২৩–১৯২৯ |
৩১তম | হার্বার্ট হুভার | ১৯২৯–১৯৩৩ |
৩২তম | ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট | ১৯৩৩–১৯৪৫ |
৩৩তম | হ্যারি এস. ট্রুম্যান | ১৯৪৫–১৯৫৩ |
৩৪তম | ডুইট ডি. আইজেনহাওয়ার | ১৯৫৩–১৯৬১ |
৩৫তম | জন এফ. কেনেডি | ১৯৬১–১৯৬৩ |
৩৬তম | লিন্ডন বি. জনসন | ১৯৬৩–১৯৬৯ |
৩৭তম | রিচার্ড নিক্সন | ১৯৬৯–১৯৭৪ |
৩৮তম | জেরাল্ড ফোর্ড | ১৯৭৪–১৯৭৭ |
৩৯তম | জিমি কার্টার | ১৯৭৭–১৯৮১ |
৪০তম | রোনাল্ড রিগান | ১৯৮১–১৯৮৯ |
৪১তম | জর্জ এইচ. ডব্লিউ. বুশ | ১৯৮৯–১৯৯৩ |
৪২তম | বিল ক্লিনটন | ১৯৯৩–২০০১ |
৪৩তম | জর্জ ডব্লিউ. বুশ | ২০০১–২০০৯ |
৪৪তম | বারাক ওবামা | ২০০৯–২০১৭ |
৪৫তম | ডোনাল্ড ট্রাম্প | ২০১৭–২০২১ |
৪৬তম | জো বাইডেন | ২০২১–২০২৫ |
৪৭তম | ডোনাল্ড ট্রাম্প (দ্বিতীয়বার) | ২০২৫–বর্তমান |
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পদ্ধতি
সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন একটি বিশেষ পদ্ধতি, ইলেকটোরাল কলেজের মাধ্যমে। এই ব্যবস্থায় ৫৩৮ জন ইলেকটর নির্বাচিত হন, যাঁরা শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করেন, কে হবেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট।
ইলেকটোরাল কলেজের গঠন ও কার্যপ্রণালী
যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের নির্দিষ্টসংখ্যক ইলেকটর থাকেন, যা নির্ধারিত হয় সংশ্লিষ্ট রাজ্যের কংগ্রেস সদস্যদের সংখ্যার ভিত্তিতে। কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভস-এর সদস্য সংখ্যা নির্ভর করে প্রতিটি রাজ্যের জনসংখ্যার ওপর, আর সিনেটের প্রতি রাজ্যের জন্য থাকে দুটি করে আসন।
আরও পড়ুন: ভারতের সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী দেশসমূহ এবং তাদের সাথে সম্পর্ক
সব মিলিয়ে, ৫০টি রাজ্যের ৪৩৫ জন রিপ্রেজেনটেটিভ, ১০০ জন সিনেটর এবং ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার তিনজন ইলেকটর মিলে মোট ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোট নিয়ে গঠিত হয় ইলেকটোরাল কলেজ।
ইলেকটোরাল ভোটের ভূমিকা
প্রেসিডেন্ট হতে হলে কোনো প্রার্থীকে ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট পেতে হয়, যা মোট ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ। ক্যালিফোর্নিয়ার রয়েছে সর্বাধিক ৫৪টি ইলেকটোরাল ভোট, যেখানে ভারমন্টের মতো ছোট রাজ্যে রয়েছে মাত্র তিনটি। মেইন এবং নেব্রাস্কা ছাড়া বাকি সব রাজ্যে ‘উইনার টেকস অল’ পদ্ধতিতে ইলেকটোরাল ভোট নির্ধারণ হয়। এর মানে হলো, যে প্রার্থী কোনো রাজ্যে এগিয়ে থাকেন, তিনি সেই রাজ্যের সব ইলেকটোরাল ভোট পান।
প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে হলে সংবিধান অনুযায়ী তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়:
- প্রার্থীকে জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হতে হবে।
- বয়স হতে হবে অন্তত ৩৫ বছর।
- যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে ১৪ বছর বসবাস করতে হবে।
তবে সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্য তৃতীয় শর্তে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক যে কেউ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে পারেন। এমনকি অপরাধী সাব্যস্ত ব্যক্তিও সংবিধান অনুযায়ী প্রার্থী হতে বাধা পান না।
সংবিধানের বিশেষ বিধান
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৪তম সংশোধনী অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যুক্ত হলে বা শত্রুদের সহায়তা করলে তিনি রাজনৈতিক পদে প্রার্থী হতে পারবেন না।
এই পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন প্রক্রিয়া বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যতিক্রমী এবং গভীরভাবে কাঠামোবদ্ধ।
যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রশংসিত ও প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট হিসেবে যাঁর নাম সবচেয়ে বেশি সম্মানের সাথে উচ্চারিত হয়, তিনি হলেন আব্রাহাম লিঙ্কন। ইতিহাসবিদদের বিশ্লেষণ এবং জনমত জরিপের ফলাফল বলছে, তাঁর সময়কালে নেওয়া সাহসী সিদ্ধান্ত এবং মানবাধিকারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান তাঁকে মার্কিন জনগণের হৃদয়ে চিরস্থায়ী করে তুলেছে।
১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে, আব্রাহাম লিঙ্কন এক ঐতিহাসিক সময়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন — গৃহযুদ্ধ। তিনি একদিকে দেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য লড়াই করেন, অন্যদিকে দাসপ্রথা বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যান।
১৮৬৩ সালে তাঁর জারি করা এম্যান্সিপেশন প্রোক্লেমেশন (Emancipation Proclamation) মার্কিন ইতিহাসে দাসমুক্তির দিশারি হয়ে দাঁড়ায়।
তাঁর বিখ্যাত গেটিসবার্গ ভাষণ (Gettysburg Address) আজও বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘোষণাপত্র হিসেবে স্মরণ করা হয়।
অন্যান্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট যারা ইতিহাসে স্মরণীয়
আব্রাহাম লিঙ্কনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে আরও কয়েকজন প্রেসিডেন্ট রয়েছেন, যারা দেশের সংকটময় মুহূর্তে অসাধারণ নেতৃত্বের নিদর্শন রেখেছেন:
জর্জ ওয়াশিংটন (George Washington)
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং জাতির পিতা। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্ব নতুন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভিত্তি নির্মাণে অপরিসীম অবদান রেখেছিল।
ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট (Franklin D. Roosevelt)
মহামন্দা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ভয়াবহ সংকটকালে দেশের নেতৃত্ব দেন। তাঁর নিউ ডিল নীতিমালা দেশের অর্থনীতিকে পুনর্জীবিত করেছিল।
থিওডোর রুজভেল্ট (Theodore Roosevelt)
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত হিসেবে তিনি অর্থনৈতিক সংস্কার, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক নীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা জোরালো করেন।
জন এফ. কেনেডি (John F. Kennedy)
তরুণ ও উদ্দীপ্ত নেতৃত্বের প্রতীক। চন্দ্রাভিযান কর্মসূচির সূচনা এবং নাগরিক অধিকার আন্দোলনে তাঁর সমর্থন আজও যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রগতির গল্পের অংশ।