দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের বিধান বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করল হাইকোর্ট। মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) বিচারপতি ফারাহ মাহবুব এবং বিচারপতি দেবাশীষ রায়চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন।
রায়ের মূল অংশ পাঠ করেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। তিনি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীকে আংশিক অবৈধ বলে ঘোষণা করেন। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সংবিধানই দেশের সর্বোচ্চ আইন, আর সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ হলো এর ধ্রুবতারা।
রায় ঘোষণার দিন
এর আগে, গত ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুলের রায় ঘোষণার জন্য ১৭ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন। দীর্ঘ ২৩ কার্যদিবস শুনানি শেষে এই রায় ঘোষণা করা হলো।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদ উদ্দিন। রিটকারী সুজনের বদিউল আলমের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া।
রাজনৈতিক দলের পক্ষে শুনানি
বিএনপির পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল ও অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল।
জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির ও ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিকী।
ইনসানিয়াত বিপ্লবের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান।
এছাড়াও চার আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার জুনায়েদ আহমেদ চৌধুরী এবং ইন্টারভেনর হিসেবে শুনানি করেন ব্যারিস্টার হামিদুল মিসবাহ।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী
২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
এরপর ১৯ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনীকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকারের বেঞ্চ।
![তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরল](https://amarcampus24.com/wp-content/uploads/2024/12/তত্ত্বাবধায়ক-সরকার-ব্যবস্থা-ফিরল.jpg)
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের পক্ষে যুক্তি
বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে দলীয় নেতারা এই রুলে অংশ নেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। রুলে ইন্টারভেনর হিসেবে গণফোরামসহ চার আবেদনকারী পক্ষভুক্ত হন।
হাইকোর্টের এই রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত আসলো, যা আগামী সংসদ নির্বাচন আয়োজনের পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। আদালত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কিছু অংশকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে সংবিধান ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষায় একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।
বিশ্লেষকদের মত
এই রায়ের ফলে রাজনীতিতে নতুন আলোচনা এবং বিতর্ক শুরু হতে পারে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের বিরোধিতা করে আসা দলগুলো এই রায়কে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। অন্যদিকে সরকারপক্ষ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারে বলেও আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
সংবিধান পরিবর্তনের সুপারিশ
সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা হ্রাস, একজন ব্যক্তির জন্য দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার নিষেধাজ্ঞা, এবং প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান ও সংসদ নেতা হওয়া থেকে বিরত থাকার শর্ত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন বুধবার তাদের সুপারিশমালা প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়। এই প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ পরে কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
যেগুলো পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে
- কমিশন সংবিধানের মূলনীতি,
- সংসদের কাঠামো,
- অন্তর্বর্তী সরকারের রূপ,
- মৌলিক অধিকারের সম্প্রসারণ,
- বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ,
- স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন
- এবং জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা
এগুলো সহ আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংশোধনী আনার প্রস্তাব দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিষ্ঠার পর সংবিধান সংস্কারের জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ এবং দুর্নীতি দমনসহ ছয়টি ক্ষেত্রের সংস্কারের জন্য আলাদা কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। এই ধারাবাহিকতায় ৭ অক্টোবর অধ্যাপক আলী রীয়াজকে প্রধান করে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।
এই কমিশনে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের ও অধ্যাপক মোহাম্মদ ইকরামুল হক, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার এম মঈন আলম ফিরোজী, লেখক ফিরোজ আহমেদ, মানবাধিকারকর্মী মো. মুসতাইন বিল্লাহ এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি সালেহ উদ্দিন সিফাত। কমিশনকে ৯০ দিনের মধ্যে তাদের সুপারিশ জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।