এইচএমপিভি ভাইরাস (HMPV Virus), ভারতে তিন শিশু আক্রান্ত। করোনা ভাইরাসের মতো লক্ষণযুক্ত নতুন একটি ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এই ভাইরাসটি হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) নামে পরিচিত। ভারতের কর্ণাটকে দুই, তিন ও আট মাস বয়সী তিন শিশুর শরীরে এই ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে।
আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান
সোমবার কর্ণাটকের স্বাস্থ্যমন্ত্রী দীনেশ গুন্ডু রাও এই পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন। তিনি জনগণকে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। তিন মাস বয়সী এক শিশুকে ইতোমধ্যে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। আট মাস বয়সী আরেক শিশুর চিকিৎসা চলছে এবং সে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। অপর এক শিশুও চিকিৎসাধীন রয়েছে।
ভারতে এই ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণের খবর পাওয়া গেলেও এর বিস্তার নিয়ে এখনও বড় ধরনের উদ্বেগ দেখা যায়নি।
২০২০ সালের করোনা ভাইরাস মহামারির পর এবার চীনে নতুন এই ভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পরছে। শিশুদের মধ্যে বিশেষ ভাবে এই ভাইরাসের প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে। চীনের পর মালয়েশিয়াতেও এইচএমপিভি (HMPV) ভাইরাসটি শনাক্ত হয়েছে। মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জনগণকে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
এইচএমপিভি (HMPV) ভাইরাস
এইচএমপিভি (HMPV) সাধারণত শীতের সময় বেশি সক্রিয় থাকে। ভাইরাসটি মূলত ঠাণ্ডা জ্বরের মতো উপসর্গ সৃষ্টি করে। উপসর্গগুলোর মধ্যে কাশি, জ্বর, নাক বন্ধ এবং শ্বাসকষ্ট উল্লেখযোগ্য। গুরুতর সংক্রমণের ক্ষেত্রে এটি ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়ার মতো জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই ভাইরাসটি শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল এমন মানুষের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
চীনের বিভিন্ন প্রদেশে ফ্লু-জাতীয় রোগের হার বাড়ছে। তবে সরকারিভাবে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না আসায় তথ্য গোপনের অভিযোগ তুলেছেন অনেকে। দেশটির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ভাইরাসটির বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এটি বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ
সিডিসি জানিয়েছে, এইচএমপিভি (HMPV) একটি শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস, যা সব বয়সের মানুষের জন্য ক্ষতিকর। তবে ভাইরাসের প্রকোপ থেকে বাঁচতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং যেকোনো উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চীনে সংক্রমণ বেড়েছে
চীনে সম্প্রতি হিউম্যান মেটানিউমো ভাইরাস (এইচএমপিভি -HMPV) সংক্রমণের হার বেড়েছে, যা নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এই ভাইরাস কোনো নতুন হুমকি সৃষ্টি করছে না।
ইনকিউবেশন পিরিয়ড
এইচএমপিভি (HMPV) ভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড সাধারণত ৩ থেকে ৬ দিনের মধ্যে থাকে। সংক্রমণের তীব্রতা অনুযায়ী লক্ষণগুলো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের উপসর্গগুলো অনেকটা সাধারণ ফ্লুর মতো।
চিকিৎসকরা নিশ্চিত করেছেন, এই ভাইরাস প্রধানত শ্বাসতন্ত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো এক সপ্তাহের মধ্যে ধীরে ধীরে কমে যায়।
এইচএমপিভি (HMPV) ভাইরাসের পরিচিতি
চীনা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের ভাইরোলজি ইনস্টিটিউটের গবেষক ঝেং লিশু বলেছেন, এইচএমপিভি (HMPV) কোনো নতুন ভাইরাস নয়। এটি ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। ২০০০-এর দশকের শুরুতে বিজ্ঞানীরা প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত করেন। বৃদ্ধির হার কম এবং অস্পষ্ট লক্ষণের কারণে এটি দীর্ঘদিন নজরের বাইরে ছিল।
চীনের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এইচএমপিভি ভাইরাসের জন্য নির্দিষ্ট কোনো টিকা বা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। তবে সংক্রমণ মোকাবিলায় সঠিক যত্নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পর্যাপ্ত বিশ্রাম, হালকা খাবার গ্রহণ এবং উপযুক্ত পোশাক পরা।
বিশেষজ্ঞরা সংক্রমণ প্রতিরোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন:
- মাস্ক ব্যবহার করা
- নিয়মিত হাত ধোয়া
- বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখা
- জনাকীর্ণ এলাকা এড়ানো
চীনা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ভাইরাস বড় কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে না। তবে সংক্রমণ বাড়ায় পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা সবাইকে সতর্ক থাকার পাশাপাশি সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।
এইচএমপিভি (HMPV) ভাইরাসের লক্ষণসমূহ
এইচএমপিভি (HMPV) বা হিউম্যান মেটাপনিউমোভাইরাস (Human Metapneumovirus) একটি শ্বাসযন্ত্রজনিত ভাইরাস যা শিশু, বয়স্ক ও রোগপ্রবণ ব্যক্তিদের মধ্যে বেশি আক্রান্ত করে। এটি সাধারণত ঠান্ডাজনিত অসুখ বা নিউমোনিয়ার মতো উপসর্গ সৃষ্টি করে এবং রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস (RSV)-এর মতো লক্ষণ প্রকাশ পায়।
এই ভাইরাস মূলত শ্বাসনালিকে আক্রান্ত করে এবং সাধারণ ঠান্ডা থেকে শুরু করে তীব্র শ্বাসকষ্ট পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে।
সাধারণ লক্ষণসমূহ-
- নাক দিয়ে পানি পড়া (Runny nose)
- কাশি
- হাঁচি
- জ্বর
- গলা ব্যথা
- মাথাব্যথা
- ক্লান্তি ও অবসাদ
গুরুতর লক্ষণসমূহ (বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে)
- শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
- বুকে শ্বাসের সময় কষ্টকর আওয়াজ (wheezing)
- নিউমোনিয়ার লক্ষণ (জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা)
- খাওয়ার অনীহা (বিশেষত শিশুদের মধ্যে)
- অতিরিক্ত ঘুমে ঢলে পড়া বা অচেতন ভাব
- ত্বকে নীলচে আভা (অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে)
যারা বেশি ঝুঁকিতে
- ৫ বছরের নিচের শিশু
- ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে বয়স্ক ব্যক্তি
- প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল যাদের (যেমন: ক্যান্সার রোগী, অঙ্গপ্রতিস্থাপনকারী)
- অ্যাজমা, সিওপিডি বা ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা
এইচএমপিভি (HMPV) ভাইরাসের কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা ভ্যাকসিন নেই। সাধারণত লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা (fever reducer, fluid intake, rest) এবং গুরুতর ক্ষেত্রে হাসপাতালের সহায়তা প্রয়োজন হয়। তাই এই ভাইরাসের লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
এইচএমপিভি (HMPV) ভাইরাস প্রতিরোধে করণীয়
এইচএমপিভি (HMPV) বা হিউম্যান মেটাপনিউমোভাইরাস একটি শ্বাসতন্ত্রজনিত ভাইরাস, যা সহজেই একজনের থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও এখন পর্যন্ত এই ভাইরাস প্রতিরোধে কোনো নির্দিষ্ট টিকা বা ওষুধ নেই, তবে কিছু সহজ কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যায়।
আরও পড়ুন: ভারতের সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী দেশসমূহ এবং তাদের সাথে সম্পর্ক
নিচে এই ভাইরাস থেকে নিজেকে এবং পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় তুলে ধরা হলো-
হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন
- সাবান ও পরিষ্কার পানি দিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুতে হবে।
- বিশেষ করে হাঁচি-কাশির পরে, বাইরে থেকে ফিরে, খাবার খাওয়ার আগে এবং শিশুদের খাওয়ানোর পূর্বে হাত ধোয়া অত্যন্ত জরুরি।
- সাবানের অভাব হলে অ্যালকোহল-যুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে।
হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলুন
- কাশির সময় মুখ ও নাক টিস্যু বা কনুইয়ের ভাঁজ দিয়ে ঢেকে নিন।
- ব্যবহৃত টিস্যু ব্যবহারের পরপরই ফেলে দিন এবং সঙ্গে সঙ্গে হাত ধুয়ে ফেলুন।
আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন
- যাদের মধ্যে ঠান্ডা, কাশি, শ্বাসকষ্ট বা জ্বর রয়েছে, তাদের কাছ থেকে অন্তত ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন।
- আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলাদা ঘরে রাখা এবং তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র আলাদা রাখা নিরাপদ।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় রাখুন
- দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিস যেমন দরজার হাতল, মোবাইল, টেবিল, খেলনা, সুইচ বোর্ড ইত্যাদি নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করুন।
- ঘর পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবাহমান রাখুন।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ান
- পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত পানি পান, ঘুম ও ব্যায়াম রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।
- শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তিদের প্রতি বাড়তি যত্ন নেওয়া জরুরি।
উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
- এইচএমপিভির লক্ষণ যেমন জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি দেখা দিলে চিকিৎসা গ্রহণে দেরি করবেন না।
- শিশু বা বয়স্কদের ক্ষেত্রে উপসর্গ গুরুতর হলে হাসপাতালে ভর্তি করানো হতে পারে।
এইচএমপিভি (HMPV) ভাইরাসকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই, বিশেষ করে শিশু ও দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারীদের ক্ষেত্রে। সঠিক স্বাস্থ্যবিধি, পরিচ্ছন্নতা এবং আগাম সচেতনতা এই ভাইরাস থেকে সুরক্ষা পাওয়ার মূল চাবিকাঠি। এখনই সচেতন হই, সুস্থ থাকি।
এইচএমপিভি (HMPV) ভাইরাস এবং করোনা ভাইরাস (COVID-19) এর মধ্যে মূল পার্থক্য
পার্থক্যের বিষয় | এইচএমপিভি (HMPV) ভাইরাস | করোনা ভাইরাস (COVID-19) |
ভাইরাসের পরিবার | Paramyxoviridae | Coronaviridae |
প্রথম শনাক্ত | ২০০১ সালে | ২০১৯ সালে (উহান, চীন) |
উপসর্গ | জ্বর, কাশি, সর্দি, শ্বাসকষ্ট | জ্বর, শুকনো কাশি, ক্লান্তি, স্বাদ/ঘ্রাণ হারানো |
সংক্রমণ ক্ষমতা | মাঝারি | অত্যন্ত বেশি (মহামারি সৃষ্টি করেছে) |
ঝুঁকিপূর্ণ | শিশু, বয়স্ক ও দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন | সব বয়স, বিশেষ করে বয়স্ক ও কো-মরবিডিটি রোগীরা |
টিকা | নেই | আছে (Pfizer, Moderna, AstraZeneca ইত্যাদি) |
চিকিৎসা পদ্ধতি | উপসর্গ অনুযায়ী | অ্যান্টিভাইরাল, অক্সিজেন, আইসিইউ প্রয়োজনে |
প্রতিরোধ ব্যবস্থা | স্বাস্থ্যবিধি ও সচেতনতা | স্বাস্থ্যবিধি, মাস্ক, টিকা, সামাজিক দূরত্ব |
প্রভাবের পরিমাণ | সীমিত ও মৌসুমি | বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রভাব (স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি) |