ভারতের সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী দেশসমূহ এবং তাদের সাথে সম্পর্ক

ভারতের সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী দেশসমূহ এবং তাদের সাথে সম্পর্ক কেমন সে বিষয় গুলো জানার চেষ্টা করবো। নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সময় বলেছিলেন, তাঁর প্রধান নীতিগুলোর একটি হবে ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’।

অর্থাৎ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন। তবে দশ বছর পর চিত্রটা উল্টো। প্রতিবেশী নয়টি দেশের মধ্যে ভারতের সঙ্গে বেশিরভাগের সম্পর্কই অবনতি হয়েছে। বিশেষ করে ২০২৪ সাল এদিক থেকে ভারতের জন্য আরও চ্যালেঞ্জিং ছিল।

ভারতের সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী দেশ

ভারতের সীমান্ত রয়েছে –

  • নেপাল
  • ভুটান
  • মিয়ানমার
  • আফগানিস্তান
  • পাকিস্তান
  • চীন
  • বাংলাদেশ

এছাড়া সমুদ্রসীমান্ত রয়েছে

  • শ্রীলঙ্কা
  • মালদ্বীপ

সবমিলিয়ে প্রতিবেশী দেশের সংখ্যা নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক কূটনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বলছে, মোদি সরকারের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সীমান্ত দৈর্ঘ্য

সীমান্তবর্তী দেশসীমান্ত দৈর্ঘ্য (কিমি)
বাংলাদেশ৪,০৯৬ কিমি
চীন৩,৪৮৮ কিমি
পাকিস্তান৩,৩২৩ কিমি
নেপাল১,৭৫১ কিমি
মায়ানমার১,৬৪৩ কিমি
ভুটান৬৯৯ কিমি
আফগানিস্তান*১০৬ কিমি

বি.দ্র.: ভারতের আফগানিস্তানের সাথে সরাসরি স্থলসীমান্ত নেই বর্তমান সময়ে, তবে ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের (পিওকে) অংশের মাধ্যমে ১০৬ কিমি ‘ডুরান্ড লাইন’ অনুযায়ী সীমান্ত ছিল। বর্তমান অবস্থায় কার্যকর সীমান্ত নেই।

নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক

নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আগেও টানাপোড়নের মধ্যে ছিল। তবে এ বছর ভারতের পরোক্ষ সমর্থনে নেপালে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের ঘটনা জনমনে ভারতবিরোধী মনোভাবকে আরও উসকে দিয়েছে। সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে ভারতবিরোধী বিক্ষোভ করেছেন। এই পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাবে, এমন আশা কম।

ভুটানের সঙ্গে সম্পর্ক

ভুটান, যা একসময় ভারতের ওপর নির্ভরশীল ছিল, এখন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী। দোকলাম ইস্যুতে চীনের সঙ্গে আলোচনার ইঙ্গিত দিয়ে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, সীমান্ত সমস্যার সমাধান হতে পারে চীনের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে। এই মনোভাব ভারতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক

মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধ এবং বিদ্রোহীদের দখলে ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল চলে যাওয়া ভারতের জন্য উদ্বেগজনক। মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এতটাই খারাপ হয়েছে যে, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

চীনের সঙ্গে সম্পর্ক

চীনের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিবাদ ২০২৪ সালেও মেটেনি। বরং পূর্ব লাদাখে সেনাদের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে উত্তেজনা আরও বেড়েছে।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক

পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক চিরকালই বৈরী। কাশ্মীর ইস্যুতে চারবার যুদ্ধ হয়েছে। এই সম্পর্কের উন্নতির সম্ভাবনা এখনো নেই।

সম্প্রতি ভারত শাসিত কাশ্মীরের পহেলগাওতে জঙ্গি হামলায় ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যু হয়। এই হামলার জন্য ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করছে। এটিকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে আবারো যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে ভারত।

সিন্ধু পানি বন্টন চুক্তি ভারত স্থগিত করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান ভারতকে তাদের আকাশ সীমা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ভারত থেকে পাকিস্তানের সকল নাগরিকদের দ্রুত বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ভারত পাকিস্তান সীমান্তে ভারত এবং পাকিস্তানের সেনাবাহিনীদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে।

মালদ্বীপের সঙ্গে সম্পর্ক

মালদ্বীপের নতুন প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ মুইজ্জুর ভারতবিরোধী মনোভাব ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্ককে আরও খারাপ করেছে। তাঁর ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগানের ভিত্তিতেই ক্ষমতায় আসা এবং সেনা প্রত্যাহারের দাবি ভারতের জন্য বড় আঘাত।

শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সম্পর্ক

শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েক চীনের ঘনিষ্ঠ। তাঁর শাসনামলে শ্রীলঙ্কায় ভারতের প্রভাব কমে চীনের প্রভাব বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক

প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বরাবরই তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাবলিতে সেই সম্পর্কেও ফাটল ধরেছে। গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান। সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন ভারতের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট করেছে।

পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ভারত বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা প্রদানে সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। এতে দুই দেশের মধ্যে চিকিৎসা, পর্যটন, বিনোদন এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে। এর ফলে উভয় দেশের নাগরিক এবং ব্যবসায়িক মহলে ক্ষোভ বাড়ছে।

এছাড়াও, সম্প্রতি ভারতের আগরতলায় অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসে হামলার একটি ঘটনা ঘটেছে। যা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও উত্তপ্ত করেছে। এই ঘটনার পর বাংলাদেশ সরকার কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিষয়টি দ্রুত সমাধানের দাবি জানিয়েছে।

দুই দেশের সম্পর্কের এই অবনতি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য উদ্বেগজনক। বিশেষ করে দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সম্পর্ক পুনরায় স্থিতিশীল করতে উভয় দেশকেই সচেতন হতে হবে।

বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে গুরুতর ত্রুটি রয়েছে, যার কারণে একের পর এক প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে। ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতির ব্যর্থতা ভারতকে তার কূটনৈতিক অবস্থান পুনর্বিবেচনার তাগিদ দিচ্ছে।

(তথ্যসূত্র: দ্য হিন্দু, ইন্ডিয়া টুডে, বিবিসি, এএফপি, ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট।)

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দুই দফা বাংলাদেশ সফর করেছেন। প্রথমবার ২০১৫ সালের ৬ জুলাই এবং দ্বিতীয়বার ২০২১ সালের ২৬ মার্চ। তবে ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এক নতুন মোড়ে প্রবেশ করেছে।

শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে ভারতে অবস্থান করছেন। এর পর থেকেই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি ভারত একাধিক অভিযোগ তুলেছে। বিশেষত, বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারার বিষয়টি ভারত বারবার তুলে ধরছে।

উত্তেজনার প্রভাব বাণিজ্যে

উভয় দেশের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার প্রভাব সরাসরি পড়ছে বাণিজ্যে। ভারতীয় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের আগস্টের তুলনায় ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রপ্তানি ২৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এ পরিস্থিতি দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কেও চাপ তৈরি করছে।

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি

দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে এ কারণে ভারতের “নেইবারহুড ফার্স্ট” নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

তার মতে,

“ভারতের সবসময় লক্ষ্য থাকে নিজের উন্নয়নের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করা এবং সেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।”

পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ সম্পর্ক

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং দুই দেশের মধ্যে উদ্ভূত উত্তেজনা কেবল রাজনৈতিক নয়। বরং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তবে পারস্পরিক সংলাপ ও সহযোগিতার মাধ্যমে উত্তেজনা কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করলে উভয় দেশের জন্যই এটি ইতিবাচক ফলাফল আনতে পারে।

প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক কেন গুরুত্বপূর্ণ?

ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা

প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকলে অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সহজ হয়। সীমান্ত বিরোধ বা সংঘাত এড়ানো যায়।

অর্থনৈতিক সহযোগিতা

পরস্পরের সাথে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতি হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, ও মায়ানমারের সাথে ভারতের অনেক যৌথ প্রকল্প রয়েছে।

সামরিক নিরাপত্তা

সীমান্তে সহযোগিতা বাড়ালে সন্ত্রাসবাদ, চোরাচালান ও অনুপ্রবেশের ঝুঁকি কমে যায়। চীন ও পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন নিরাপত্তার দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা

নদী ও পানিসম্পদ যৌথভাবে ব্যবস্থাপনা করা প্রয়োজন, কারণ অনেক নদী একাধিক দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়, যেমন গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র।

সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংযোগ

ভারত ও তার প্রতিবেশীদের মধ্যে ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্মীয় সংযোগ গভীর। এই সংযোগ রক্ষা ও উন্নয়ন জনগণের মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।

আঞ্চলিক সংগঠন ও কূটনীতি

সার্ক (SAARC), বিমসটেক (BIMSTEC) ইত্যাদি আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করে উন্নয়ন সম্ভব হয়, যা পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নত করে।

কৌশলগত কারণ

বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব বজায় রাখতে এবং বড় শক্তিগুলোর (যেমন চীন, যুক্তরাষ্ট্র) প্রভাব মোকাবিলা করতে প্রতিবেশীদের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক প্রয়োজন।

Leave a Comment